চলো হাঁটি-২
মেঘনা সেতুর নিচে চলে এসেছি। বসে আছি নদীর তীরে। কত সুন্দর করে পাথর বসিয়ে রেখেছে। পানির ঢেউ এসে পাথরের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। সেই সময় পানির ঢেউয়ের শব্দটা বেশ ভালো লাগছে। তার চেয়ে বেশি ভালো লাগছে অদেখা বস্তুর আলিঙ্গন। শরীরটাকে একেবারে শীতল করে দিচ্ছে। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি হলো বাতাস। যে বাতাসকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। আমি বাতাসের স্পর্শে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আচ্ছা বাতাসের কি ওজন আছে?
একটা পাথরের সাথে আরেকটা পাথর লেগে আছে। পাথরে পাথরে প্রেম করছে নাতো! করতেই পারে। আমি পাথরের ওপর শুয়ে আছি। ওপরে খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি। কিন্তু বাতাসের কি ওজন আছে? এটা নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ছোট সময় কোনো একটা ক্লাসে বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছিলাম বাতাসেরও ওজন আছে। আচ্ছা আলোকে জিজ্ঞেস করি বাতাসের ওজন বিষয়ে।
রাত নয়টা বাজতে চলল, আলোকে কল দিলাম।
‘কোথায় আছো?’
‘তার আগে বলো বাতাসের ওজন আছে, এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?’
‘মানে কী? ফোন করে আজব প্রশ্ন?’
‘এটা তোমার কাছে আজব প্রশ্ন মনে হলো?’
‘আজব নয়তো কী, মানুষ ফোন করে শুরুতে বলে, হ্যালো কেমন আছো, কী করছো?’
‘আমার অত সময় নাই। আমি ডাইরেক্ট কাজে বিশ্বাসী। আমি ডাইরেক্ট অ্যাকশনে যেতে পছন্দ করি।’
আমার কথা শুনে আলো হেসে উঠল। আমি বরাবরই আলোর হাসির কাছে দুর্বল। আলো একগাল হেসে বলে, ‘এটা আমি বিশ্বাস করি না?’
‘কোনটা?’
‘এই যে তুমি বললে, ডাইরেক্ট অ্যাকশনে তুমি বিশ্বাসী?’
‘হ্যাঁ আমি ঠিক বলেছি।’
‘তাহলে আমাকে ঘোরাচ্ছ কেন? আমাকে ডাইরেক্ট বিয়ে করে ফেলো।’
আলোর কথা শুনে আমি থেমে গেলাম। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলেছে। আলো আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আমি ভালোবাসি কি না জানি না। তবে আলোকে আমার খুব ভালো লাগে। আপাতত বাতাসের ওজনের বিষয় নিয়ে ভাবছি না। এখন একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগত। উঠে যাব কি না ভাবছি। কিন্তু শরীর বলছে আরেকটু বিশ্রাম নিতে।
পৃথিবীতে বাতাস এমন একটা বস্তু যে কি না মানুষের সব ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে। আমার কানে ঢেউয়ের শব্দ এসে বলছে, ‘আসো তুমি আমার কাছে এসো।’ বাতাস শন শন করে বলছে, ‘তুমি নিদ্রা যাও সখা।’ কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে কে যেন আমার পায়ে স্পর্শ করছে। খুব বেশি ঠান্ডা লাগছে পায়ে। কী হতে পারে? চারপাশে জনমানবের কোলাহল নেই বললেই চলে। তার মানে রাত অনেক। আচ্ছা কটা বাজতে পারে এখন? মে বি ১২টা। বুঝতে পারছি পায়ের সাথে সাপের স্পর্শ লেগেছে। তারপরও আমি চোখ মেলছি না। কী ভয়ংকর ব্যাপার। শরীরটাকে পাথরের সাথে লেলিয়ে রেখেছি। কেননা ঠিক এই মুহূর্তে আমার জীবন মরণের যুদ্ধ চলছে।
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী অযথা শক্তিপ্রয়োগ করতে চায় না। সাপও আমাকে ছোবল দেবে না। কারণ ছোবল দিতে হলে সাপের শক্তিপ্রয়োগ করতে হবে। আমি একদম নড়াচড়া করছি না। তাকাচ্ছিও না। আমি তাকালে সাপ দেখে ফেলতে পারে। সাপের দৃষ্টিশক্তি কিন্তু খুব বেশি তীক্ষ্ণ হয়। মিনিট পাঁচেক পর সাপের স্পর্শ থেকে আমি বঞ্চিত হলাম। এবার চোখ মেলে দেখি একটু দূরে সাপের চলে যাওয়া। ও মাই গড, এত বিশাল আকারের সাপ। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। বাতাসের গতি কমেছে। আমার কপালে ঘাম। তার মানে আমার মধ্যে যথেষ্ট ভয় কাজ করছে।
হাঁটতে হাঁটতে ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু টাইম দেখে কিছুটা বিস্মিত হলাম। রাত ২টা পেরিয়ে। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনুভব করছি আমি এখন ক্ষুধার্ত। কিছু না খেলেই নয়। এক কাপ চায়ের সাথে দুটি বানরুটি খাওয়া যেতে পারে। একজন মুরব্বি চা বানাচ্ছে। বয়স্ক মানুষ এত রাতেও জীবিকা নির্বাহের জন্য চা বিক্রি করছে। মুরব্বিকে বললাম, ‘আমাকে একটা চা দেন কাকা।’
‘চায়ের দাম কিন্তু ১২ টাকা।’
খটখটে মেজাজে মুরব্বির কথা শুনে দিনের বেলার কথা মনে পড়ে গেল। যে মুরব্বি কাঁদায় পড়ে গিয়েছিল। যাকে বাঁচাতে গিয়ে উল্টো বকা খেয়েছিলাম। আচ্ছা বয়স্ক মানুষ কি তাহলে এমনই হয়। এত রাতে ঝামেলাতে যাওয়া যাবে না। চলে গেলাম পাশের দোকানে। এক কিশোর ছেলে চা বানাচ্ছে। বললাম চা দিতে। সাথে দুটি বানরুটি। ছেলেটি তাই দিল। চায়ের দাম ১২ টাকা। দুটি রুটি ১০ টাকা। ২২ টাকা বিল। কিন্তু ছেলেটি আমার কাছ থেকে ২০ টাকা রাখল। ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম।
পেটের খিদে নিবারণ হয়েছে। বেশ ভালো লাগছে। আকাশে চাঁদটা জোছনা ছড়িয়ে দিয়েছে। নিরিবিলি কোথায় যাওয়া যেতে পারে। যেখানে কোনো মানুষ থাকবে না। তৎক্ষণাৎ মনে হলো বাসায় যাওয়াটা উত্তম। গভীর রাতে আর বাইরে থাকা ঠিক হবে না। ভৈরব বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসায় চলে গেলাম।
বাড়িতে মেহমানের আগমন। ফুফু–ফুফা ফুফাতো বোন সাথে বোনের বান্ধবীও এসেছে। বোনের নাম শেলী বান্ধবীর নাম কোহিনূর। মা বলছে আজকে দুপুরে খাবার সবাইকে নিয়ে একসাথে খাবে। আমি ঘুমে মগ্ন। শেলী আমাকে ডাকছে, ‘সোম ভাইয়া ওঠো। মামানি ডাকছে।’
আমি উঠছি না। সকালে এদের সবার সাথে কথা হয়েছে। চোখে প্রচুর ঘুম। কিন্তু শেলী নাছোড় বান্দা, আমাকে না উঠিয়ে ছাড়বে না। সে আমার গায়ের ওপর থেকে কম্বল টান দেয়। আমি সাথে সাথে কম্বল ধরতে গিয়ে শেলীর ওড়না ধরে দিলাম টান। হালকা–পাতলা কাপড়, সেটা বুঝতে পেরে তাকিয়ে দেখি শেলীর ওড়না আমার হাতে। সাথে সাথে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু শেলী ওড়না নিচ্ছে না। আমার ঘুম বিদায় হলো। পাশে কোহিনূর হাসছে। শেলী বলে, ‘তাহলে এই ছিল তোমার মনে।’
‘কী বলছিস!’
‘কী বলব, যা দেখার তা তো এখন দেখে নিলাম। তুমি থাকো, আমি এখনই মামানিকে সবকিছু বলছি।’
‘কী বলবে?’
‘বলব তুমি আমার ওড়না নিয়ে গেছো, আর...!’
‘আর?’
‘তুমি আমার সাথে...?’
আমি শেলী গলাতে ওড়না দিয়ে বলি, ‘খুব পাকা হয়ে গেছিস। যা মাকে এসব না বলে কদিন পরে যে ছেলের সাথে তোর বিয়ে হবে, তাকে গিয়ে বলিস।’
‘তুমি আমাকে পছন্দ করো, সেটা আগে বললেই পারতে।’
‘পছন্দ করি তো। বোনকে ভাই পছন্দ করবে না তো কাকে করবে।’
এমন সময় কোহিনূর বলে ওঠে, ‘শেলী, তুই কী ভেবেছিস, সোম সাহেব কিন্তু অনেক চালাক মানুষ। দেখেছিস কত সুন্দর করে কথাগুলো বলছে।’
‘এবার তাহলে তোরা যা, আমি পরে আসছি।’
‘কোহিনূর আপনি কিন্তু যথেষ্ট সুন্দর আছেন।’
‘সেই আশায় গুড়েবালি, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মামাতো ভাইয়ের সাথে। দুবাই থাকে।’
‘কিরে, তোদের দুজনেরই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, তাহলে আমার হবে কী?’ চলবে...
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]