চলো হাঁটি
সেই সকালে বৃষ্টি হয়েছিল। এখনো রাস্তার কিছু অংশে পানি জমে আছে। মাঝেমধ্যে পা ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো কত সুন্দর করে রেখেছে সে দেশের সরকার। যত সমস্যা আমাদের দেশে। বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। এটা একটা বিরাট সমস্যা বলে আমি মনে করি। আমি না হয় হেঁটে কোনো রকম চলে যাচ্ছি, কিন্তু সামনে যে মুরুব্বি আসতেছেন, লাঠিতে ভর করে তিনি কীভাবে যাবেন। না, একটু দাঁড়াই, দেখি, বৃদ্ধ লোকটি জায়গাটা কীভাবে পার হন। এদিকে কলাপাতার সৌন্দর্য দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। হালকা বাতাসে পাতাগুলো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। আরে, এটা কী! একটা পাখি কত সুন্দর করে কলা খাচ্ছে। কিন্তু কলা পুরোপুরি পাকেনি। যাক, এটা কোনো বেপার নয়, পাখি বেচারা তো খাবেই। তার তো পেট আছে।
হায় হায়! চাচা পড়ে গেছেন! আমি দৌড়ে এসে চাচাকে ধরে তোলার চেষ্টা করছি। এমন সময় চাচা বললেন,
‘সরে যাও বলছি। আমাকে ধরবে না।’
চাচার কথা শুনে আমি রীতিমতো শক খেলাম। আমি ছেড়ে দিলাম। এবার আবার পড়ে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি মুরুব্বিকে। মুরুব্বি এবার বললেন, ‘বেয়াদব ছেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে।’
কী মুশকিল! মুরুব্বি বলেন কী! এত মারত্মক! আমি বললাম, হায় চাচা, আপনি বলেন কী? আপনি তো বললেন ছেড়ে দিতে। তাই তো আমি ছাড়লাম। এখন আপনি বলতেছেন, আমি আপনাকে ধাক্কা মেরেছি। আপনি এত বড় মিথ্যা বলতে পারলেন।
চাচা আমাকে বকাও দিচ্ছেন, যা–তা বলে যাচ্ছেন, আমি হাসছি। এই বৃদ্ধ মানুষটা কেন এমন। সেটা না ভেবে চলে আসতে চাইলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে চাচা তাঁর লাঠি দিয়ে আমাকে আঘাত করতে চাইলে আমি দিলাম লাঠি ধরে টান। তারপর আরও বড় একটা সমস্যা হয়ে গেল। সেটা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আমি লাঠি নিয়ে চলে আসতেছি। এবার চাচা চিৎকার করে বলছেন, ‘এই বাজান আমার লুঙ্গি দিয়ে যা, আমার লুঙ্গি দিয়ে যা..!’
মানে লাঠির বাঁকা অংশের সঙ্গে লেগে চাচার লুঙ্গি চলে আসে। হায় হায়, এটা তাহলে বলে ফেললাম। সরি চাচার জন্য বলা হয়ে গেছে।
আমি হাঁটছি। চাচাকে নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। আমাকে হাঁটতে হবে। কেন যে আমার এত ভালো লাগে হাঁটতে, সেটা বলতে পারব না। মুরব্বি মানুষ হবে নরম মনের। আজকে যেই মুরব্বিকে দেখলাম, তওবা তওবা। চাচার কথা বাদ। চলে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। এই জায়গাটা বেশ পরিপাটি। ছোট ছোট সিএনজিচালিত গাড়িগুলো ফুড়ুৎ করে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। এটাও দেখার বিষয়। মানুষ কত ব্যস্ত। এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা, আমি কিসে ব্যস্ত? ও মনে পড়েছে, আমি হাঁটতে ব্যস্ত। দ্বারিয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে ভৈরবের দিকে গেলে মন্দ হয় না।
আমি একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠে বসলাম। অনেক সময় হেঁটেছি। একটু বিশ্রামও হলো আর গন্তব্যে যাওয়াও হলো।
ভৈরব মেঘনা ব্রিজে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে। লোকজনের কমতি নেই এই সেতুতে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ আবার ভিডিও বানাচ্ছেন। যুগের কত পরিবর্তন। একটা সময় মানুষ নিজেকে দেখার জন্য দর্পণ খুঁজে পেত না। আর এখন মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন। যখন যা মন চায়, তা–ই করে। এই স্যোসাল মিডিয়ার যুগে বিনোদন এখন সবার হাতে হাতে। যা–ই হোক, আরেকটু হাঁটা যাক। দুই কদম সামনে আগাতেই একটি নারী কণ্ঠের আমার কানে প্রবেশ করল।
‘হ্যালো ভাইয়া, আমাকে একটু হেল্প করবেন।’
আমি হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালাম। সে আবার বলে, ‘ভাইয়া...।’
আমি হাত বাড়ালাম মোবাইলটা নেওয়ার জন্য। মেয়েটি মোবাইলটা আমাকে দিল। আমি ক্যামেরা অন করে মেয়েটির কয়েকটি ছবি তুলে দিলাম, মেয়েটি খুশি। তবে এই খুশির মধ্যে কিছুটা শঙ্কা আছে। আমি হাতের ইশারায় বললাম, ‘তুমি কি ভিডিও করবে’ সে বলল, ‘জি ভাইয়া।’
পজিশনে দাঁড়িয়ে ভিডিও রেকর্ড চালু করি। ঠিক তখন মেয়েটি দুটি হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘হ্যালো গায়েজ, আমি এখন আছি ভৈরব মেঘনা ব্রিজে। কত সুন্দর দেখো আমাদের ঐতিহ্যবাহী মেঘনা ব্রিজ। তোমরা আসতে পারো আমাদের এই ব্রিজে। আমার ভিডিওটি কেমন লাগল, অবশ্য কমেন্ট করে জানিয়ে দেবে।’
ভিডিও বানানো শেষ। আমি মেয়েটিকে মোবাইল ফিরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মেয়েটি আমাকে দেখে অবাক। অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, আমি মেয়েটির সঙ্গে একটা কথাও বলিনি। এটাই মেয়েটি ভাবছে। হয়তো আমি বোবা কি না, সেটাও ভাবছে।
মেয়েটি আমার কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়তো আমাকে নিয়ে ভাবছে। এমন সময় কবিগুরুর ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী...’ আমার পকেটে বাজতেছে। আমি মোবাইল বের করে রিসিভ করি। মেয়েটি তাকিয়ে আছে।
বলো, কেমন আছো?
ও পাশ থেকে আলো বলছে, ‘কোথায় তুমি?’
এই তো ভৈরব মেঘনা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
ছবি তোলা মেয়েটি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। তার মনের সংশয় দূর হলো। আমি আলোকে বলি, তুমি জানো, ঠিক এই মুহূর্তে তুমি একটা মেয়ের সংশয় দূর করে দিয়েছ।
‘বুঝলাম না।’
মানে হলো, আমার কাছে একটা মেয়ে এসে বলছে, ‘ভাইয়া আমাকে কয়েকটা ছবি তুলে দেবেন।’ আমি কোনো কথা না বলে তার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ছবি তুলে দিলাম। ভিডিও করে দিলাম।
‘বুঝলাম। মেয়েটির সংশয় কিসের?’
সেটাই তো বলছি। মেয়েটি আমার সঙ্গে পাঁচ–সাত মিনিট ছিল। এর মধ্যে আমি মুখে একটি কথাও বলিনি। শুধু মেয়েটির কাজ করে দিয়েছি। এর জন্য হয়তো মেয়েটি ভাবছিল, আমি বোবা কিনা।
‘ও বুঝতে পেরেছি। এখন আমি ফোন দিয়েছি আর তুমি কথা বলেছ, মেয়েটিও বুঝতে পারল তুমি বোবা নও।’
একদম।
‘তুমি না কেমন যেন। কী ক্ষতি হতো মেয়েটির সঙ্গে একটু কথা বললে?’
বাদ দাও মেয়েটির কথা। এখন বলো, তুমি কী করছ?
‘আমি ঢাকায় চলে এসেছি। তুমিও ঢাকায় চলে এসো।
না বাবা, আমি ঢাকায় যাব না। ঢাকার যে অবস্থা, সেখানে আমার হাঁটতে অনেক কষ্ট হবে।
‘আমি আছি তো। আমাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটব। দুজন হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব আকাশের ওই নিকটে। যেখানে থাকব শুধু তুমি আর আমি।’
আলোর কথার মধ্যে অনেক মায়া। আলো যখন কথা বলে, তখন আমি বোবা হয়ে যাই। মেয়েটি যে আমাকে কত ভালোবাসে। পৃথিবীতে আলোর মতো সুন্দরী মেয়ের সংখ্যা অতি অল্প। চলবে...