বিয়েভীতি–শেষ পর্ব

এসআই বারেক সাহেব আর কনস্টেবল রফিক সাহেব আমাকে নিয়ে একটা রুমে বসেছেন। টেবিলের ওপর ছয়টি গরম ডিম রাখা। ডিম দেখার পর থেকেই ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমি এতক্ষণ ভেবেছিলাম, ডিমের কথা বলে পুলিশ আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। এখন বুঝলাম এরা সিরিয়াস। ভয়ে একটা ঢোঁক গিলে বললাম,
-রফিক ভাই, সব কটি ডিমই কি আমার জন্য?

-কেন ছয়টায় হবে না? আরও লাগবে? আপনার তো আবার সবকিছুই বেশি বেশি লাগে, তাই না? এক রাতের জন্য ছত্রিশ প্যাকেট কেনেন। আচ্ছা আপনি কী করেন?
-কিছু করি না। আমি বেকার।

এবার রফিক সাহেব, বারেক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-স্যার, ব্যাটার গায়ের পাঞ্জাবিটা একটু দেখেন। কত দামি একটা পাঞ্জাবি। বেকার মানুষ এত দামি পাঞ্জাবি পরে কীভাবে? সেই কারণেই আমি বলছি, এই ব্যাটা একজন নারী ব্যবসায়ী।

-রফিক ভাই, আপনার যুক্তিটা ভুল। আমি বেকার, কিন্তু আমার পরিবার তো বেকার না। এই পাঞ্জাবি আমার স্ত্রী আমাকে কিনে দিয়েছেন।

এবার এসআই বারেক সাহেব আমাকে প্রশ্ন করলেন,
-আপনার স্ত্রী কী করেন?
-সে–ও বেকার।
-আপনিও বেকার, সে–ও বেকার? তা এই বেকার অবস্থায় বিয়ে করার কারণ কী?
-স্যার, বিশ্বাস করেন, এই বিয়ে আমি করতে চাইনি। আমার স্ত্রী খুবই বিচ্ছু টাইপের একটা মেয়ে। সে আমাকে জোর করে বিয়ে করেছে। প্রতিবাদ করতে পারিনি। কারণ, তাকে আমি ভয় পাই।
-তা এখন আপনাদের সংসার চলবে কীভাবে?
-স্যার, এটা নিয়ে এখনো কোনো চিন্তা করিনি। সবই আল্লাহ ভরসা। তবে এই মাত্র আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। ভাবছি গুলিস্তান, মতিঝিল, নিউমার্কেটসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নাচ-গান করে পয়সা কামাই করব।
-সেটা কীভাবে?
-স্যার, আমার স্ত্রীর গলা খুবই সুন্দর। ভাবছি, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে লোক জড়ো করব। এরপর আমার স্ত্রী বাংলা সিনেমার বিভিন্ন চটুল গান গাইবে। আর আমি সেই গানের তালে তালে নাচব। নাচ দেখে পাবলিক খুশি হয়ে আমাদের যা দেবে, তা দিয়েই সংসার চালাব। বুদ্ধিটা কেমন, স্যার?
বারেক সাহেব টিটকারির সুরে বললেন,
-খুবই ভালো বুদ্ধি। তা আপনি কি নাচ জানেন?
-না স্যার, নাচ জানি না। তবে সেটা কোনো সমস্যা না। বাংলা সিনেমার নাচ খুবই সহজ একটা জিনিস। এটা যে কেউ চাইলেই করতে পারবে।

-তাই নাকি!
-জি, স্যার। বাংলা সিনেমার নাচের জন্য আপনাকে পাঁচটি জিনিস করতে হবে। এক, নাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোমরটা অনবরত নাড়াতে হবে। দুই, সেই সাথে পুরো শরীরটা মৃগীরোগীর মতো ঝাঁকাতে হবে। তিন, মাঝেমধ্যে একটু এদিক-ওদিক দৌড়াতে হবে। চার, সেই সাথে ছোট ছোট লাফ দিতে হবে। আর পাঁচ নম্বর হচ্ছে, নাচের সময় চোখ-মুখ বাঁকিয়ে, ভুরু নাচিয়ে, ঠোঁট কামড়িয়ে গান গাইবে। ব্যস, নাচ হয়ে গেল।
-নাচ হয়ে গেল!
-জি, স্যার। সেই রকম নাচ। স্যার আপনি চাইলে আমি আপনাকে শিখিয়ে দিতে পারি। শিখবেন, স্যার? আপনার জন্য একদম ফ্রি।
বারেক সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। উনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে রফিক সাহেব বলে উঠলেন,
-স্যার, এ ব্যাটা তো পুলিশকে বোকা মনে করতেছে। স্যার, ও নাচটাচ কিছুই জানে না। ও এসব ভুংভাং কইরা, আমাদের বোকা বানাচ্ছে। ও এমন ভাব করতেছে, যাতে আমরা মনে করি ও একজন নিরীহ সাধারণ মানুষ। এবং সেটা ভেবে ওকে আমরা ছাইড়া দিই। স্যার ও মিষ্টি কথায় কিছুই স্বীকার করবে না। আপনি অনুমতি দেন, আমি ডিম দেওয়া শুরু করি। দেখবেন, সব গড়গড় করে স্বীকার করে ফেলবে।
বারেক সাহেব হাত তুলে রফিক সাহেবকে থামিয়ে দিলেন। আমি রফিক সাহেবকে বললাম,
-রফিক ভাই, আমি যে নাচ জানি, আপনি তা বিশ্বাস করছেন না, তাই না? ঠিক আছে আপনি একটা গান ধরেন, আমি আপনাকে নেচে দেখাচ্ছি। আপনি কি চাকভুম চাকভুম গানটি জানেন? জানলে ওই গানটা ধরেন। ওটা আমার প্রিয় গান।
-স্যার দেখছেন, এ ব্যাটা এখনো মশকরা করতাছে। ওর কত বড় বুকের পাটা, ও পুলিশকে গান গাইতে বলে! স্যার, আমি ডিম দেওয়া শুরু করি? ডিম গরম–গরম দেওয়া উত্তম। এতে কাজ ভালো হয়।
-রফিক ভাই, আপনার সমস্যা কী? আপনি কি জীবনে এই একটা কাজই শিখছেন? পুলিশ একাডেমিতে এত ট্রেনিং করছেন, সেগুলো মনে নাই। সারাক্ষণ ডিম ডিম করতাছেন।

-স্যার দেখলেন, ও এখন আমার ট্রেনিং নিয়াও মশকরা করতাছে। স্যার আপনি অনুমতি দিলে দেন, না দিলে নাই। আমি ডিম দেওয়া শুরু করলাম।
এরপর রফিক সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিটমিট করে বললেন,
-আমি পুলিশ একাডেমিতে কী শিখছি, তা তোর জানার খুব শখ, তাই না? দাঁড়া এবার একে একে ছয়টি ডিম দিয়া তোরে বুঝাব, আমি পুলিশ একাডেমিতে কী শিখছি।
এ কথা শোনামাত্র বারেক সাহেবের মুখে আবার বমির ভাব ফুটে উঠল। উনি রফিক সাহেবের কথার কোনো উত্তর দিলেন না। এদিকে বারবার ডিমের হুমকি দেওয়ার কারণে, রফিক সাহেবের ওপর আমার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। রাগের মাথায় আমি আমার প্যান্ট খোলার জন্য বেল্টে হাত দিলাম। এ সময় বারেক সাহেব আমাকে বললেন,
-আপনি প্যান্ট খুলছেন কেন?
-স্যার, এনাফ ইজ এনাফ। আপনি দেখছেন না, রফিক সাহেব ডিম দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই কাপড় খুলে রেডি হচ্ছি। স্যার, আমি আপনাকে আবারও বলছি, আমি কিন্তু রুম পরিষ্কার করতে পারব না।
এ সময় বারেক সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর রফিক সাহেবকে বললেন,
-রফিক সাহেব, আমি এই রুম থেকে চলে যাচ্ছি। আপনি উনারে ডিম দেন বা যা খুশি করেন। আমি আর এসবের মধ্যে নাই।
-কেন স্যার? আপনি রুমে থাকবেন না কেন? ডিম তো আমি দেব। আপনি শুধু বসে বসে দেখবেন।
- দূর মিয়া, আপনি জানেন, ওই লোকের পেট খারাপ? উনার আমাশয় হয়েছে। আপনি ডিম দেওয়ার সাথে সাথে তো...
বারেক সাহেব বাক্যটি শেষ করতে পারলেন না। উনি আবারও হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে, এক দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। বাথরুম থেকে ভেসে আসা আওয়াজে বুঝলাম, বেচারা আবারও বমি করছেন। রফিক সাহেব অবাক চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি আমার পেট খারাপের কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন। বুঝতে পারছেন না, এখন কী করবেন।

আমি অলরেডি বেল্ট খুলে ফেলেছি। এবার প্যান্টের বোতাম খুলতে লাগলাম। বোতাম খুলতে খুলতে বললাম,
-রফিক ভাই তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমার কিন্তু প্রচণ্ড টয়লেট পেয়েছে। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ আটকায়ে রাখতে পারব না। যেকোনো সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে।
বাক্যটা শেষ করতে না করতেই, রফিক সাহেবও দৌড় দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। দুজনে এখন একই বাথরুমে বমি করছেন।
একটু আগে তুলির মামা থানায় এসেছেন। বড় লোকদের ব্যাপারই আলাদা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ আমাকে ছেড়ে দিলেন। থানা থেকে চলে আসার সময় ভাবলাম, বারেক সাহেবের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে যাই। কিন্তু উনাকে থানায় পেলাম না। শুনলাম উনি নাকি বমি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবে ভাগ্য ভালো রফিক সাহেবকে পেয়েছি। উনাকে সালাম দিয়ে বললাম,
-রফিক ভাই, আপনি কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখেননি। আপনি বলেছিলেন ডিম দেবেন। আমি কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু আপনি তো দিলেন না। তবে নেকস্ট টাইম কিন্তু দিতেই হবে। বমি করলে চলবে না। ভালো থাকবেন। আপনার সাথে শিগগিরই আবার দেখা হবে।
-অসম্ভব, তোর সাথে আমার আবার দেখা হবার প্রশ্নই আসে না। আমার এ জীবনে আমি আর তোকে দেখতে চাই না।
-বলেন কি? আমি যদি আবার মধ্যরাতে রাস্তায় বের হই? আপনি আমাকে ধরবেন না?
-প্রশ্নই আসে না। আমি এই জীবনেও তোরে আর রাস্তায় আটকাব না। তুই যদি আমার সামনে খুনও করিস, তবুও তোরে আমি ধরব না। প্রয়োজনে তোর ছবি আমি নিজে সব থানায় সাপ্লাই করব। আর ছবির নিচে লিখে দেব, ‘এরে ধরা নিষেধ। এবং এর সাথে কথা বলাও নিষেধ।’

-কেন রফিক ভাই?
-কারণ তুই পাগল। তোর মাথায় সমস্যা আছে। তুই সকল আইনের ঊর্ধ্বে। তুই এখন দূর হ আমার সামনে থেকে।
আমাদের নিয়ে গাড়ি দ্রুত ছুটে চলছে। আমি মামার সাথে পিছনের সিটে বসেছি। মামা চুপ করে আছেন। উনি আমার সাথে কোনো কথাই বলছেন না। অবশ্য এ মুহূর্তে আমার নিজেরও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খুবই ক্লান্ত লাগছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মামার ডাকে যখন চোখ খুলে বাইরে তাকালাম। দেখলাম আমরা এফ রহমান হলের সামনে। আমি অবাক হয়ে মামাকে প্রশ্ন করলাম,
-মামা, আমরা এখান কেন? আমি তো তুলির কাছে যাব।
-তুলি ওদের বাসায় চলে গেছে। আমি তুলিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, তারপর তোমাকে আনতে থানায় গিয়েছিলাম। তুলি আমাকে বলেছে, তোমাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে হলে পৌঁছে দিতে। ও আরেকটা কথা, তুলি, তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে না। ও একটা চিঠি দিয়েছে। আমার ধারণা, তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর সেখানে পেয়ে যাবে।
এ কথা বলে মামা আমাকে একটি খাম এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,
-ভালো থেকো। আর ছেলেমানুষিটা একটু কম করার চেষ্টা করো। খোদা হাফেজ।
মামার গাড়ি চলে যেতেই হলের সামনের ফুটপাতে পা ঝুলিয়ে বসলাম। তারপর ধীরে ধীরে তুলির চিঠিটি খুললাম।
‘টারজান,
প্রথমেই সরি। আমার কারণে আজ তোর ওপর অনেক ঝামেলা গেছে। আমার পাগলামির কারণে, তোকে হুট করে বিয়ে করতে হলো, মামার বাসায় অপমানিত হতে হলো, আবার থানায় গিয়ে নাজেহালও হতে হলো।

তুই তো স্বাধীন জীবন চাস, তাই না? যা, আজ তোকে মুক্ত করে দিলাম। তোকে আর জ্বালাব না। শোন, আমাকে নিয়ে তোকে কোনো টেনশন করতে হবে না। তুই তোর স্বাধীন জীবন উপভোগ কর। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করিস না। অবশ্য চেষ্টা করলেও আমার দেখা আর পাবি না। তুই তো জানিস, আমি যা বলি, তাই করি।
ও আরেকটি কথা, তোকে শুধু মুক্তি দিয়েছি। তোকে কিন্তু ডিভোর্স দিইনি। কারণ, অতটা ভালো মানুষ আমি নই।
ভালো থাকিস।’
গত সাত দিন আমার পরিচিত সব জায়গায় তুলির খোঁজ করেছি। অনেকবার তুলির ফোনে ফোন দিয়েছি। কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। তুলির মামা, ওর কাজিন, ওর বন্ধু, আমাদের কমন বন্ধু, যাদের নম্বর আমার কাছে আছে, তাদের সবাইকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু কেউ তুলির কোনো খবর দিতে পারেনি। এমনকি আমার এক বন্ধুকে তুলির বাসায়ও পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা তুলির ব্যাপারে কোনো কথাই বলেননি। আশ্চর্য, একটা মানুষ পুরাই হাওয়া হয়ে গেল!
কেন জানি এই স্বাধীন জীবনটাকে আর ভালো লাগছে না। জীবনটাকে এখন অনেক কষ্টকর মনে হচ্ছে। আমি সাধারণত কান্না করি না। কেউ কখনো আমাকে কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু এখন সারা দিনই কেবল কান্না পায়। এই যেমন আমি এ মুহূর্তেও কাঁদছি। তুলির জন্য কাঁদছি।
(গল্পটা এখানেই শেষ করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার পুরোনো একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। সেই গল্পটা এ রকমই একটা জায়গায় শেষ করার কারণে, অনেক পাঠক কড়া কড়া কমেন্ট করেছিলেন। এবার তাই গল্পটা এখানে শেষ করলাম না।)
এই কয়েক দিন বাবা-মা কারও ফোন রিসিভ করিনি। হঠাৎ মনে হলো বাবাকে একটা ফোন দিই। বাবার সাথে কথা বলে মনটা একটু হালকা করি। এক রিং হতেই বাবা ফোন রিসিভ করলেন।

-বাবা তোমার কি একটু সময় হবে?
-আমার সব সময় তো তোর জন্য। কী হয়েছে তোর? গত কয়েক দিন তোকে এত ফোন করলাম, তুই তো ফোন ধরলি না। তোর কি শরীর খারাপ?
-না বাবা, শরীর ভালো আছে। তবে মনটা খারাপ। খুব কান্না পাচ্ছে।
-কেন?
বাবাকে সব খুলে বললাম। বাবা সব শুনে বললেন, বাড়ি চলে যেতে। আমি বাবাকে বললাম,
-বাবা আমিও তাই ভাবছি। ঢাকা শহরটাকে আর ভালো লাগছে না। আমি ঠিক করেছি এই শহরটাকে একবারে বিদায় দিয়ে গ্রামে চলে আসব। আমি কালই বাড়ি আসছি।
পরদিন ঠিক সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি পৌঁছলাম। বাবা-মাকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। দুজনেই আমার কান্না দেখে অবাক হলেন। কারণ, তারা কখনো আমাকে কাঁদতে দেখেননি। বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
-তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে অনেক ধুমধাম করে আবার বিয়ে দেব।
-বাবা, তোমার কি মনে হয়, আমি বিয়ের জন্য কাঁদছি?
-না। আমি জানি, তুই বিয়ের জন্য কাঁদছিস না, তুই বউয়ের জন্য কাঁদছিস।
এ কথা বলেই বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি জানি, বাবা আমাকে হাসানোর জন্য ফান করার চেষ্টা করছেন।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। জার্নির ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বন্ধ হয়ে এল। আমি আস্তে আস্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঠিক সে সময় মনে হলো বহুদূর থেকে তুলির কণ্ঠ ভেসে আসছে। তুলি আমাকে ডাকছে। চিৎকার করে বলছে,
-ওই কুত্তা ওঠ। আজ রাতে ঘুমালে তোকে আমি খুন করে ফেলব।
আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। দেখলাম, তুলি লাল বেনারসি পরে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তুলির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি আসলে বুঝতে পারছি না, এ কি স্বপ্ন না বাস্তব? তুলি আমার চেহারা দেখে সম্ভবত আমার মনের কথা টের পেল। ও বলল,
-জি না, তুই স্বপ্ন দেখছিস না।

-তুই কখন এলি? কীভাবে এলি? এত দিন কোথায় ছিলি?
-কোথায় ছিলাম মানে? আমি তো গত সাত দিন এই বাসায়। আমার স্বামীর বাসায়।
-মানে কী?
-সেদিন আমি মামার বাসা থেকে আমাদের বাসায় গিয়ে বাবাকে সব খুলে বললাম। তারপর কান্নাকাটি করে বাবাকে রাজি করালাম। বাবাকে বললাম, আমি আজই শ্বশুরবাড়ি যাব। বাধ্য হয়ে বাবা নিজে এসে আমাকে এখানে দিয়ে গেলেন। এখানে এসেই ফোন বন্ধ করে রেখেছি। আর সবাইকে বলে দিয়েছি, তোকে আমার খবর না দিতে।
-মাইগড, তোর মাথায় এত বুদ্ধি?
- আরে না, এই পুরো পরিকল্পনাটা আমার শ্বশুরের, মানে তোর বাবার। সেদিন তুই থানা থেকে আমাকে ফোন করার পর আমি তোর বাবাকে ফোন করে সব খুলে বলি। তখন উনিই পুরো প্ল্যানটা আমাকে দিলেন। বললেন, তোকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। না হলে তুই জীবনেও ঠিক হবি না।
বলেই তুলি খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি বিছানা থেকে নেমে তুলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরেই হুহু করে কাঁদতে লাগলাম। আমি এর আগে তুলিকে কখনো হাগ করিনি।একটু পর তুলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তারপর একটা বড় প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
-এটা হাগের সময় না। আগে কাজ শেষ করো, তারপর হাগ দিস। তোর না বেলুন দিয়ে বাসরঘর সাজানোর প্ল্যান? এখানে ছত্রিশটি প্যাকেট আছে। সব কটি এখন তুই একা ফুলাবি। তারপর ওই সব বেলুন দিয়ে ঘরটা সাজাবি। সাজানো শেষে আমি তোর পরীক্ষা নেব।
-কিসের পরীক্ষা?
-তুই কি আসল টারজান, নাকি ভুয়া টারজান, সেটা আমার জানা খুবই দরকার। কারণ এটা নিয়ে আমি খুব টেনশনে আছি।

বলেই আবার হাসতে লাগল।
-সব বেলুন দিয়ে যদি ঘর সাজাই, তাহলে পরীক্ষা দেব কীভাবে?
-ওগুলো ছাড়াই পরীক্ষা দিবি। কারণ মা-বাবা বলেছেন তোকে দ্রুত বাবা বানাতে হবে। তাদের ধারণা, তুই বাবা না হওয়া পর্যন্ত তোর এসব পাগলামি যাবে না।
আমি এখন বসে বসে বেলুন ফোলাচ্ছি। আর তুলি বিছানায় বসে আমাকে দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। এ পর্যন্ত ত্রিশটি ফোলানো হয়েছে। আর মাত্র ছয়টি বাকি।
বেলুন দিয়ে ঘর সাজানো শেষে তুলির পাশে গিয়ে বসলাম। বসে তুলিকে বললাম,
-তুলি, তোর কাছে কি আসলেই আর কোনো প্যাকেট নেই?
-না। কেন?
-তাহলে আজ রাতে ওই সব পরীক্ষা-টরিক্ষা বাদ। কারণ, বেকার অবস্থায় সন্তান নেওয়া ঠিক হবে না। বেকার অবস্থায় বাবা হলে, সবাই আমার সন্তানকে টিটকারি করে বলবে, বেকার বাবার সন্তান।
দেখলাম, তুলি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
-এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
-শোন, আমার বোঝা হয়ে গেছে। তোর মতো ভুয়া টারজানকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।
এ কথা বলেই বিচ্ছু মেয়েটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমাপ্ত


*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]

আরও পড়ুন