কালের সাক্ষী ‘গদখালী রেলস্টেশন’

গদখালী স্টেশনের টিকিট কাউন্টার
ছবি: লেখক

যশোরের প্রাচীন জনপদ গদখালীর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, উনিশ শতকের গোড়ায় এটি বেশ সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৮১০ সাল নাগাদ ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রকোপে এই অঞ্চলের মানুষ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়। বিপর্যয় কাটাতে না কাটাতেই ১৮৪০ সালে পুনরায় আক্রান্ত হয় গদখালীসহ এর আশপাশের অঞ্চল। সে সময় প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে এই এলাকা। ‘গদখালী ফিবার’ নামে যা ইতিহাসে আজও স্থান করে আছে। মনোজ বসু তাঁর ‘সে এক দুঃস্বপ্ন ছিল’ উপন্যাসে গদখালীর এই রূপ তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন, ‘খানপাঁচেক গ্রামের পরে সুবিখ্যাত গদখালী...মহামারিতে এক সময়ে ওই গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, মেয়েপুরুষ একজন-কেউ বেঁচে ছিল না।’ ১৮৭১ সালে প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অব দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব ইটস এন্টিকুইটিজ, ইটস হিস্টোরি অ্যান্ড ইটস কমার্স’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গদখালী ছিল বাজার পরিবেষ্টিত একটি বৃহদায়তনের গ্রাম। ১৮৬৩ সালে কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম পাড় তথা বর্তমান গদখালী যশোরের অন্তর্ভুক্ত হয়। গভীর বন ও ডাকাতদের অভয়াশ্রম হওয়ায় গদখালীতে একটি পুলিশ স্টেশন স্থাপিত হয়।

রেললাইনসহ গদখালী রেলস্টেশনের পার্শ্ব চিত্র। ছবি কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশ রেলওয়ে ফ্যানস ফোরাম (বিআরএফএফ), রাতুল আমিন

১৮৭৬-৭৮ সালে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত হওয়া মহা দুর্ভিক্ষের পর, ফেমিন কমিশনার এ অঞ্চলে ন্যূনতম পাঁচ হাজার মাইল রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সীমিত সরকারি ব্যয়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তিনি এই কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রয়াস পান। বলা যায়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ধারণাটির শুভসূচনা ঘটেছিল এই সময়ে। এগিয়ে আসে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলে রেলপথ সম্প্রসারণের দায়িত্ব পায় বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে। ১৮৮২ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে দমদম জংশন থেকে দত্তপুকুর, দত্তপুকুর থেকে গোবরডাঙ্গা, রানাঘাট থেকে বনগাঁও এবং বনগাঁও থেকে খুলনা পর্যন্ত চার ধাপে সর্বমোট ১২৫ দশমিক ২৫ মাইল রেলপথ নির্মাণ করে কোম্পানিটি। এই পুরো পথটিই ব্রডগেজ লাইন (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি)। বেনাপোল থেকে যশোরও এই রুটের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৩৮ সালের সরকারি নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেনাপোল থেকে যশোর পর্যন্ত যেতে পথে পড়তে নাভারন, গদখালী, ঝিকরগাছা ঘাট, ঝিকরগাছা ও ধোপাখোলা স্টেশন। যশোর থেকে খুলনা হয়ে গোপালনগর পর্যন্ত ছিল এই রেলপথের সীমানা। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ পেট্রাপোল হয়ে গদখালীর ওপর দিয়ে খুলনা যাওয়া রেলগাড়িটির নাম ছিল ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’। যাত্রার শুরুতেই এটি যাত্রীদের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘রিপোর্ট অন দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব বেঙ্গলের (১৮৮৪-৮৫) তথ্য মোতাবেক— ১৮৮৪ সালে প্রথম শ্রেণিতে ২ হাজার ৭৩৮ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২১ হাজার ৯১৯ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩৯ হাজার ৮০২ জন এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪৭ জন যাত্রী এই পথে রেল ভ্রমণ করেন। ১ জুলাই ১৯০৫ সালে সরকার বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে কিনে নেয়। তখন থেকে এটি পুরোপুরিভাবে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

শিয়ালদহ থেকে খুলনা (দমদম থেকে গোপালনগর) পর্যন্ত রেলস্টেশনের তালিকা ও দূরত্ব। উৎস: ইস্টার্ন ইন্ডিয়া কোল ট্যারিফ নং ৪১, মে ১৯৩৮, পাবলিকেশনস ডিপার্টমেন্ট, ৬ ফেয়ারলি প্যালেস, কলকাতা

‘ফলেন সিগন্যাল পোস্ট ডিরেইলস ইঞ্জিন’ শিরোনামে একটি রেল দুর্ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় ১৯১৪ সালের ১৯ মে প্রকাশিত ‘দ্য বোম্বে ক্রনিকল’ পত্রিকায়। এটি ছিল গদখালীর ঘটনা। ডিস্ট্রিক্ট ট্র্যাফিক সুপারিনটেনডেন্ট, গদখালী যে তখন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের আওতাধীন ছিল, বিবরণীতে তা বোঝা যায়। কলকাতায় কাজকর্মের পালা সেরে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরার ট্রেন হিসেবে পরিচিত ছিল শিয়ালদহ-খুলনা রুটের এই রেল। দেশভাগের পরে পাসপোর্ট-ভিসা চালু হওয়ার পরও দুই বাংলার মধ্যে যোগাযোগ ছিল এই রুটে। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়েতে রূপান্তরিত হয়। পাকিস্তান আমলে এই পথে ট্রেন চলাচলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। শিয়ালদহ থেকে খুলনা যাওয়ার জন্য ইন্টারক্লাসের টিকিট কেটেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শুরুতে এই রুটে যাত্রীদের জন্য ফোর্থ ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বিলুপ্ত করা হয়। সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাসের মধ্যে নতুন করে ইন্টারক্লাস চালু করা হয়। চলার পথের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘টেলিফোন করে জানলাম সকাল ১১টায় খুলনার ট্রেন ছাড়ে।.... রানাঘাট এসে গাড়ি থামল অনেকক্ষণ। ভারতবর্ষের কাস্টমস অফিসাররা গাড়ি ও প্যাসেঞ্জারদের মালপত্র তল্লাশি করল, কেউ কোনো নিষিদ্ধ মালপত্র নিয়ে যায় কি না?...সন্ধ্যা হয় হয়, ঠিক এই সময় ট্রেন বেনাপোল এসে পৌঁছাল।...এখানে ট্রেন অনেকক্ষণ দেরি করল। গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও কিছু পুলিশ কর্মচারী ঘোরাফেরা করছে, ট্রেন দেখছে তন্ন তন্ন করে।...ওদের অবস্থা দেখে ট্রেনের অন্য পাশে গিয়ে আত্মগোপন করলাম।... রাত ১০টা বা ১১টা হবে, এমন সময় খুলনায় ট্রেন পৌঁছাল।’ ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’-এর সুদীর্ঘ পথচলার ইতি ঘটে।

১৯১৪ সালের ১৯ মে ‘দ্য বোম্বে ক্রনিকল’ পত্রিকায় প্রকাশিত গদখালীর রেল দুর্ঘটনার বিবরণ
উৎস: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহাগার

১৯৮২ সালে ফুলচাষি শের আলীর হাত ধরে গদখালীর পুনরুজ্জীবন ঘটে। ফুলের রাজ্য হিসেবে ক্রমেই বিকশিত হতে শুরু করে এই অঞ্চল। গদখালী ও এর আশপাশের হাজার হাজার একর জমিতে বছরজুড়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল, যার বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে দীর্ঘ ৫২ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’-এ যাত্রী চলাচলের মাধ্যমে প্রাণ ফিরে পায় কলকাতা-খুলনা রেল রুট। কলকাতা থেকে দমদম-বনগাঁ-পেট্রাপোল-বেনাপোল-গদখালী-ঝিকরগাছা-যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত চলাচল শুরু করেছে ট্রেনটি। তবে সেকালের গদখালী, ধোপাখোলা, তালতলা হাটের মতো উল্লেখযোগ্য স্টেশনগুলো বর্তমানে পরিত্যক্ত। ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর গদখালী রেলস্টেশন পরিদর্শনে দেখা যায়, খোদাই করে লেখা ‘টিকিট লইবেন’ কথাটি এখনো অক্ষত রয়েছে। এর ঠিক ওপরে বাংলা ও ইংরেজিতে টিকিট কাউন্টার খোলার সময়সূচি বর্ণনা করা। আবছা হয়ে গেলেও স্টেশন ভবনের ছাউনিতে ক্রমান্বয়ে ইংরেজি ও বাংলায় গদখালী লেখাটি কষ্ট করে পড়া যায়। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। এভাবেই বোধ হয় হারিয়ে যায় এক একটি রেলস্টেশন!

আরও পড়ুন
যাত্রীছাউনিতে ইংরেজি ও বাংলায় গদখালী লেখা স্টেশনটির সম্মুখভাগ
ছবি: লেখক

তথ্যসূত্র:
১. পূর্ব বাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭, দিনাক সোহানী কবির
২. দ্য প্রসিডিংস অব দ্য সেকেন্ড অল ইন্ডিয়া স্যানিটারি কনফারেন্স হেল্ড অ্যাট মাদ্রাজ নভেম্বর ইলাভেন টু সিক্সটিন ১৯১২ (ভলিউম-০২ হাইজিন)
৩. দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, ভলিউম-১৩৪, জুলাই ১৯০৭
৪. হানড্রেড ইয়ারস অব পাকিস্তান রেলওয়েজ, ১৯৬২
৫. অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্ট অন রেলওয়েজ ইন ইন্ডিয়া ফর ১৮৮৫-৮৬ (পার্ট-২)
৬. বিবিসি, রাকিব হাসনাত, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯