হারিয়ে যাওয়া ‘বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে’ ও ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’
তৎকালীন পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে রেলওয়ে সম্প্রসারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়েকে। ‘সহায়ক কোম্পানি’ হিসেবে এর পথচলা। বাংলা সরকারের অর্থায়নে বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জমির ব্যবস্থা হয়। কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ও সহযোগিতায় ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে। সরকারের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট চুক্তি ও শর্তের আলোকে এই রেলওয়ে পরিচালিত হতো। কোম্পানির মোট আয় থেকে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে যা থাকবে, তা থেকে সরকার পাবে পাঁচ ভাগের এক ভাগ আর বাকিটা কোম্পানি। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বর্তমান বিশ্বের বিত্তশালী পরিবারগুলোর অন্যতম রথসচাইল্ড পরিবার। কোম্পানিতে প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ মিলিয়ন স্টার্লিং। পরবর্তী সময়ে যা ৪ মিলিয়নে পৌঁছায়। রথসচাইল্ড পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম, নাথানিয়েল মায়ের রথসচাইল্ড ছিলেন বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে কোম্পানির একজন স্বত্বাধিকারী। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে ছিল তখন নাথানিয়েলের রেল ব্যবসা। বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ের মালিকানায় সংযুক্ত ছিলেন আরও একজন। তিনি ভারতে ভাইসরয় কাউন্সিলের অর্থবিষয়ক সদস্য স্যার ইভলিন বেয়ারিং। বিখ্যাত বেয়ারিং অ্যান্ড কোম্পানি এখনো যার স্মৃতি বহন করে চলছে। ব্রিটিশ আমলে এ উপমহাদেশে প্রচলিত কোম্পানি ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল ম্যানেজিং এজেন্সি প্রথা। বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ের এজেন্ট এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন স্ট্যাপলস। যাঁর বেতন ছিল মাসিক ১ হাজার ৬০০ রুপি আর তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী পেতেন ৫০০ রুপি!
১৮৮১ সালের জুলাইয়ে বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে নির্মাণকাজ শুরু করে। ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্ট অন দ্য রেলওয়েজ ইন ইন্ডিয়া ফর ১৮৮৫-৮৬ (পার্ট-২)’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রথম ‘রানাঘাট থেকে বনগাঁও’ ২০ দশমিক ২৫ মাইলের সেকশনটি রেল চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৮৮২ সালের ১৬ অক্টোবর। অতঃপর সম্পন্ন হয় দমদম জংশন থেকে দত্তপুকুর এবং দত্তপুকুর থেকে গোবরডাঙ্গার রেলপথ। ‘বনগাঁও থেকে খুলনা’ পর্যন্ত ৬১ দশমিক ৭৫ মাইলের চতুর্থ সেকশনটি উন্মুক্ত করা হয় ১৮৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। চুক্তি মোতাবেক, ১৮৮৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু ১৮৮৪ সালের ২২ এপ্রিলই খুলে দেওয়া হয় সর্বশেষ সেকশন ‘গোবরডাঙ্গা থেকে বনগাঁও’। এটি ছিল ১২ মাইল দীর্ঘ। বেঙ্গল সেন্ট্রাল কর্তৃক নির্মাণ করা সর্বমোট রেলপথের পরিমাণ ছিল ১২৫ মাইলের কিছু বেশি। পুরোটাই ব্রডগেজ রেলপথ। এই রুটে চলাচলকারী ট্রেনটির নাম ছিল বরিশাল এক্সপ্রেস। ১৮৭৮ সালের মহাদুর্ভিক্ষ–পরবর্তী সময়ে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সরকারের রেল সম্প্রসারণ নীতি যেমন বেঙ্গল সেন্ট্রালকে রেলপথ নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে, তেমনি এ অঞ্চলে পাট বাণিজ্যের বিষয়টিও তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলার অধিকাংশ জেলায় তখন পাট উৎপন্ন হলেও উৎপাদনের দিক থেকে যশোর ও খুলনা অঞ্চলের অবস্থান ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৮৯৯ সালে শুধু মালামাল পরিবহন থেকেই কোম্পানির নিট লাভ ৮৪ হাজার ৪৬৮ রুপি। যার একটা বড় অংশই ছিল পাট।
১৮৮৮ সালের মাইলপ্রতি যাত্রী ভাড়া ও মালামাল পরিবহনের হিসাব থেকে দেখা যায়, যাত্রীদের জন্য প্রথম, দ্বিতীয়, ইন্টার বা তৃতীয় এবং চতুর্থ বা সর্বনিম্ন শ্রেণির ব্যবস্থা ছিল। মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা ছিল মোট ছয় শ্রেণির। বিশেষ শ্রেণিটিতে শুধু খাদ্যশস্য ও কয়লা পরিবহনের সুযোগ ছিল। সরকারি নথি পর্যালোচনায় ভাড়া বৃদ্ধির চিত্রও খুঁজে পাওয়া যায়। ১ মে ১৮৯৯ থেকে প্রথম শ্রেণিতে মাইলপ্রতি ভাড়া ১২ পাই থেকে বৃদ্ধি করে ১৮ পাই এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছয় পাই থেকে বৃদ্ধি করে ৯ পাই করা হয়। ওই বছরের ১৫ আগস্ট কলকাতা থেকে দত্তপুকুর পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণির ভাড়াও বাড়ে। আড়াই পাই থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সেটা হয় তিন পাই। একই বছরের ১ জুলাই থেকে প্রচলন করা হয় প্ল্যাটফর্ম টিকিট। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ধার্য করা হয় ছয় পাই। এই টিকিট দিয়ে রেলে চড়া যেত না। শুধু স্টেশন চত্বরে প্রবেশের অনুমতি মিলত। বর্তমানে আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে এই ব্যবস্থা চালু থাকলেও রেলস্টেশনগুলোতে সেই ব্যবস্থা আর নেই। রেলের বিষয়াদি নিয়ে তখন প্রকাশিত হতো ‘ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং’ শিরোনামের সাপ্তাহিক জার্নাল। ১৯০১ সালের ভলিউম উনত্রিশ থেকে জানা যায়, বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়েতে শিগগিরই পরীক্ষামূলকভাবে বৈদ্যুতিক পাখা সংযুক্ত করা হবে। প্রায় ১২০ বছর পর রেলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেবিনে বসে পাখাবিহীন রেলে যাত্রার চিন্তাটা আজ বড্ড সুকঠিন! ১৯০৫ সালের ১ জুলাই সমাপ্তি ঘটে বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ের। এই রেলপথের দায়িত্বভার সম্পূর্ণরূপে সরকারের তত্ত্বাবধানে চলে আসে। পরিচালনার দায়িত্ব পায় ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে।
বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ের ইতি ঘটলেও শিয়ালদা-খুলনা রুটে ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’–এর কার্যক্রম চলে যথারীতি। ১০ জুলাই ১৯১২ সালে দ্য বোম্বে গেজেট পত্রিকায় দেখা মিলে বরিশাল এক্সপ্রেসের। তবে এটা ছিল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তৃতীয় শ্রেণির একটি বগিতে গলা ও কান ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় একজন বাঙালি তরুণীর লাশ পাওয়া যায়। বিভাগীয় প্রধান কার্যালয়ের দিকে যে ট্রেনগুলো তখন চলত সেগুলোকে বলা হতো ডাউন ট্রেন। আর বিভাগীয় প্রধান কার্যালয় থেকে গন্তব্য শুরু করা ট্রেনগুলোকে আপ ট্রেন হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম চালু ছিল। খুলনা থেকে কলকাতা অভিমুখী ছিল ৩২ ডাউন বরিশাল এক্সপ্রেস এবং কলকাতা থেকে খুলনা অভিমুখী ছিল ৩১ আপ বরিশাল এক্সপ্রেস।
বেশ কিছু উপন্যাস-আত্মজীবনীতে খুঁজে পাওয়া যায় ঐতিহ্যবাহী সেই ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’কে। অমিয় কুমার ঘোষের লেখা ‘রূপসী রূপসার ইতিকথা’ উপন্যাসে দেখা যায়, এই ট্রেনকে ঘিরেই রূপসায় মাছের আড়তদারি চলত। বিভিন্ন আড়তের মাছ কলকাতায় চালান হতো বরিশাল এক্সপ্রেসে করে। পূর্ববঙ্গে রেলের পরিষেবা যে সেকালেও খুব আশানুরূপ ছিল, সাহিত্য কিংবা ইতিহাস কোনোটাই কিন্তু তা সাক্ষ্য দেয় না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথিকের বন্ধু’ রচনায় লিখেছেন, ‘কলকাতা থেকে আসছিলাম বরিশাল এক্সপ্রেসে। বারাসাত স্টেশনে নিতান্ত অকারণে (অবশ্য যাত্রীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী) উক্ত বরিশাল এক্সপ্রেস কেন যে দাঁড়িয়ে রইল দারুব্রহ্মবৎ অনড় অবস্থায়, তা কেউ বলতে পারলে না। গন্তব্যস্থান বনগাঁয়ে পৌঁছে দেখি রাণাঘাট লাইনের গাড়ী চলে গিয়েচে।’ অবশ্য এটাই শেষবার নয়, বরিশাল এক্সপ্রেসের সময়জ্ঞানের বিষয়টি বিভূতিভূষণ বারবারই স্মরণ করেছেন। তাঁর ‘অপ্রকাশিত দিনলিপি’–তে লিখেছেন-‘২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪।...সকালে কলকাতা এলুম। বরিশাল এক্সপ্রেস ১ ঘন্টা লেট ছিল।’ সেই ট্রেনের রংটা ঠিক কেমন ছিল? এমন প্রশ্ন পাঠকের মনে উঁকি দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক। অমর মিত্রের ‘শূন্যের ঘর শূন্যের বাড়ি’ গ্রন্থে সেই উত্তর মিলে, ‘শিয়ালদা বলতে পারিস, বরিশাল এক্সপ্রেস এখেনে এসে থামত। বিজন শুনছিল কবিতা আর বড় মামার কথা। বরিশাল এক্সপ্রেসের কথা বলতেই সেই দীর্ঘ, আঁকাবাঁকা সবুজ গাড়িটির কথা মনে করতে পারল।’
সেকালে জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক ছিল দ্য হিন্দু প্যাট্টিয়ট। ‘বেঙ্গল সেন্ট্রাল ফ্লোটিলা কোম্পানি লি.’ শিরোনামে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, কোম্পানিটি ২৩ মে ১৮৮৪ হতে খুলনা ও বরিশালের মধ্যে স্টিমার সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। আসা-যাওয়ার পথে তা বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও নলছিটি স্টেশনে যাত্রাবিরতির কথা। এসব স্টিমার তখন কয়লার দ্বারা উৎপাদিত স্টিমে চলত বলে এদের স্টিমার বলা হতো। ১৮৮৪ সালের ১২ জুলাই তারিখে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দ্য বিল্ডারের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ের পরিপূরক ও সহায়ক হিসেবে গঠিত হয়েছিল কোম্পানিটি। একই মালিকানায় হলেও কোম্পানি দুটি পৃথকভাবে পরিচালিত হতো। ১৮৮৭ সালের ১ জানুয়ারি বেঙ্গল সেন্ট্রাল ফ্লোটিলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয় মেসার্স হোর মিলার অ্যান্ড কোম্পানি। তখন থেকে এর আয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৮৯৬ সাল নাগাদ কোম্পানিটি ইন্ডিয়া জেনারেল ও রিভার স্টিম জয়েন্ট কোম্পানির তত্ত্বাবধানে চলে যায়। উল্লেখ্য যে খুলনা-বরিশালের মধ্যে চলাচলকারী স্টিমারগুলোর নামও ছিল বরিশাল এক্সপ্রেস। বরিশালগামী যাত্রীরা খুলনাঘাট রেলস্টেশন হয়ে পৌঁছে যেতেন রূপসা ঘাট স্টিমার স্টেশনে। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অবধি বরিশাল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা অব্যাহত ছিল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে থেমে যায় সেই চলাচল। দীর্ঘ প্রায় ৫২ বছর পর ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয় পুনরায়। তবে সেটি ঐতিহ্যবাহী বরিশাল এক্সপ্রেস নয়, ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’। বরিশাল এক্সপ্রেস এখন শুধুই স্মৃতি।
তথ্যসূত্র
১. পূর্ব বাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭, দিনাক সোহানী কবির
২. ফাইন্যান্সিং ইন্ডিয়াস ইম্পেরিয়াল রেলওয়েজ ১৮৭৫-১৯১৪, স্টুয়ার্ট সোয়ানি
৩. অ্যাক্রস দ্য বর্ডার্স-ফাইন্যান্সিং দ্য ওয়ার্ল্ডস রেলওয়েজ ইন দ্য নাইনটিন্থ অ্যান্ড টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরিজ, রাফ রথ ও গুন্টার ডিনহব
৪. ক্ল্যাসিফাইড লিস্ট অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন রিটার্ন অব এস্টাবলিসমেন্ট, পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, ১৯০২
৫. আ হিস্টোরি অব ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ, জি এস খোসলা
৬. আ মনোগ্রাফ অন ইন্ডিয়ান রেলওয়ে রেইটস (১৯১৮), এস সি ঘোষ
৭. অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্ট অন দ্য রেলওয়েজ ইন ইন্ডিয়া ফর ১৮৮৪-৮৫ থেকে ১৮৮৯-৯০
৮. অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্ট অন দ্য রেলওয়েজ ইন ইন্ডিয়া ফর ১৮৮৯-১৯০০ (পার্ট-১ ও ২)
৯. বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, বাকেরগঞ্জ, ১৯১৮