তিতাসের কলিমুদ্দিন মাঝি

আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার অন্যতম সারথি তিতাস নদীর মাঝি কলিমুদ্দিন ভাই। উনার আন্তরিকতা-সরলতা ও কঠোর সংগ্রামময় জীবনের কথা চিন্তা করলে এখনো চোখ ভিজে যায় । কলিমুদ্দিন মাঝি-মস্তু মাঝির কথা পাঠকদের জানাতে চাই।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘মস্তু, সামালকো। তরাতরি হালডা ধর,’ কলিমুদ্দিন ভাইয়ের সতর্ক আর্তনাদ। ঢেউয়ে নৌকার অবস্থা টালমাটাল। যখন নানাবাড়ি থেকে রওনা দিই, তখনই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। এক ঘণ্টা হলো আমরা বিলে আছি। হঠাৎ উঁচু উঁচু ঢেউয়ে নৌকার দুলুনিতে আম্মা আমাদের ধরে দোয়া পড়ছেন। ‘বাবি, ডরাইন না। কুস্তা অইতো না’, মস্তু কাকা হাল সামলাতে সামলাতে আমাদের সাহস দেন।

কলিমুদ্দিন ভাই আর মস্তু কাকা সম্পর্কে বাবা আর ছেলে। কলিমুদ্দিন ভাইকে আমরা বলি ভাই আর ওনার ছেলেকে বলি কাকা। দুজনে দাদার ব্যক্তিগত পানসি নৌকার পেইড মাঝি। দাদা রউফ সাহেব শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রিটায়ার করে সরাসরি গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন। একটি সুন্দর ছইঅলা পানসি নৌকা তৈরি করেন। নৌকাটি এত সুন্দর! গলুই এবং পেছনের হালের অংশটি বেশ উঁচু। গলুই এবং এর পাশ থেকে সাদা জমিনের ওপর ময়ূরের চোখ এবং দুই দিকে বডির সাইডের অংশ ও পেছন দিকটা এমনভাবে কারুকার্য করা যেন একটি ময়ূর নদীতে ভাসছে। হালটি বেশ বড় এবং সাদা, সবুজ ও লাল নকশা করা। অত্যন্ত ভারী এ নৌকা নিয়মিত আলকাতরা ও মেরামতের মাধ্যমে ঝকঝকে রাখায় এটা আমাদের পরিবারের অন্য রকম আইডেন্টিটি দিয়েছে। ছইটি বেশ মজবুত। বেত, বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি ছইয়ের সামনের দিকে মাঝখানে একটি দরজা আর দুই পাশে দুটি ছোট জানালা। জানালার সামনের দিকটা সাদা জমিনের ওপর ফুল, নদী, উদীয়মান লাল সূর্য আর নীল মেঘের নিচে সবুজ রঙের প্রকৃতি। জানালার ভেতর দিকে রয়েছে শিকের গ্রিল এবং দুটি হুক। ছইয়ের ভেতরে জানালার পাশে একটি নারকোলের কালো খোলওয়ালা হুক্কা দড়িতে ঝুলছে। টিক্কা আর তামুক রয়েছে পাটাতনের এক পাশে একটি কাঠের বাক্সে।

কলিমুদ্দিন ভাই দ্রুত হাতে ছৈয়ের ওপরের পাল গুটিয়ে আনছেন। বিলে নৌকা পড়ার পর এ সুন্দর বাদামি পালটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পালের মাঝখানে দুটি কমলা রঙের তাপ্পি। পালে বাতাস লেগে বিশাল বপুর মানুষের ভূড়ির মতো ফুলে উঠেছিল। পাল টানানোর পরপরই নৌকার গতি বাড়তে থাকে; এতে কলিমুদ্দিন ভাইদের কষ্টটা কমে আসে।

দুপুরের আগেই নানাবাড়ির পেছন দিকে খালের গেটে মস্তু কাকাদের নৌকা ভিড়ে। দাদি সুন্দর করে তোষক, পরিষ্কার বিছানার চাদর আর বালিশ নৌকার পাটাতনে বিছিয়ে দিতে বলেছেন। সঙ্গে দিয়েছেন টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি ভাত, কই মাছের দোপেয়াজি, একটি টকজাতীয় তরকারি, শাক, ডাল ও ভর্তা। এটা নৌকায় বসে আমাদের দুপুরের লাঞ্চ।

কিন্তু নানাবাড়িতে মস্তু কাকাকে দেখেই নানা-নানি দুজনেই ওনাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। কলিমুদ্দিন ভাই আম্মার সঙ্গে দেখা না করেই থানাঘাটের দিকে চলে গেছেন তিতাসের পাড় থেকে বড় আইড়/বোয়াল বা কাতলা মাছ কিনে আনার জন্য। এটা দাদার নির্দেশ-বেয়াইবাড়ির জন্য আনতেই হবে। নানি ওনাদের প্রবল আপত্তিতে কোনো রকম কান না গলিয়ে গরম গরম পোলাও মুরগির সালুন দিয়ে খেতে বসিয়েছেন। পাশের ইজি-চেয়ারে বসে নানা তদারকি করছেন। কলিমুদ্দিন ভাইদের প্রতি নানা-নানির অসীম স্নেহ। নানি প্রায়ই বলেন, ‘ওরা বাপ-ছেলে এতো ভদ্র, সৎ-বিশ্বাসী ও ভালো মানুষ; এই যুগে দেখা যায় না।’

আরও পড়ুন

থানাঘাট থেকে একটি খাল শহরের ভেতর মৌলভীপাড়া, কাজীপাড়া, মধ্যপাড়া, ছয়বাড়িয়া হয়ে গোকর্ণঘাটে তিতাসের অপর অংশকে যুক্ত করেছে। বর্ষাকালে খালে থাকে টইটম্বুর পানি। থানাঘাট থেকে গয়না নৌকা গোকর্ণঘাট, গোঁসাইপুর, থানাকান্দি পর্যন্ত যাতায়াত করে। আমরা বর্ষায় নানাবাড়িতে এলে ছাদে বা সীমানাপ্রাচীরের দুই দিকে পা ঝুলিয়ে বসে বসে চলে যাওয়া নৌকা দেখি। পাশের পাক্কার পুলটি থেকে দুরন্ত ছেলের দল খালে ঝাঁপ দেয়। পুলটি মৌলভীপাড়াকে কাজীপাড়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর পূর্ব দিকের রেলিংয়ে দুই মানুষসমান উঁচু করে টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে নানার ব্যক্তিগত আগ্রহে এবং বাসার আব্রুর জন্য।

আম্মার তাগাদায় আমরা তাড়াতাড়ি দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষে নৌকায় উঠি। আম্মা দাদির হাতের তরকারি দিয়ে নৌকায় মজা করে খাবেন বলে অপেক্ষায় আছেন। খালে তীব্র পশ্চিমমুখী স্রোতে নৌকাকে শুধু দিক নিয়ন্ত্রণে চইড় (লগি) ব্যবহার করছেন কলিমুদ্দিন ভাইয়েরা। মাঝেমধ্যে কাজীপাড়ার দুষ্টু ছেলের দল লগি বা হাল ধরে নৌকায় ওঠার চেষ্টা করলেই ‘দূর বেত্তমিজ’ বলে কলিমুদ্দিন ভাই তাদের থামানোর চেষ্টা করে যান। পৈরতলা রেলওয়ে ব্রিজের নিচে এসে স্রোতের তীব্রতা কমে যাওয়া ওনাদের ‘চইড় মারতে’ হয়। আরেকটু সামনে গিয়েই আড়াআড়ি গ্রামের ভিতর ক্ষেতের ওপরে উঠে যাওয়া পানির ওপর দিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করেন। কালিসীমার বিলের ওপর নৌকা আসতেই আম্মা খাবার বেড়ে খেতে ডাকেন। নৌকার দুলুনী, শোঁ শোঁ বাতাস, পানির সোঁদা গন্ধে আমাদের আবার খিদে পেয়ে যায়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মস্তু কাকা আমাকে ইশারা করে হুঁক্কাটি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ছইয়ের এক পাশে দরজা আর অন্য পাশের ফাঁকা জায়গাটি একটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সমানে নৌকার গলুই থেকে ছই পর্যন্ত একপাশ থেকে মস্তু কাকা আর অন্যপাশ থেকে কলিমুদ্দিন ভাই লগি ফেলে নৌকা টেনে যাচ্ছেন। নিয়মিত বিরতিতে ঘট ঘট করে লগির সঙ্গে নৌকার বডিতে আঘাতের আওয়াজ, পানিতে ঝপ করে লগি ফেলার আওয়াজ আর লগি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাটাতনে পড়ে যাওয়া পানির আওয়াজে একসময় চোখে তন্দ্রা পেয়ে যায়।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ইমন কলিমুদ্দিন ভাইকে অনুরোধ করে লগিটি হাতে দিতে; নৌকা বাইবার জন্য। উনি হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন, ‘আর কদ্দুরা বড় হও।’ মস্তু কাকা তামুক-টিক্কা ধরিয়ে দুই–তিনটি টান দিয়ে কলিমুদ্দিন ভাইয়ের হাতে হুঁকাটি চালান দেন। আম্মাকে বাবা-ছেলের একসঙ্গে হুঁকা টানার কথা বলতেই চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘গ্রামে ঠান্ডায়, পরিশ্রমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোকজন হুঁকা খায়।’

গোকর্ণঘাট থেকে চর গোঁসাইপুর পর্যন্ত একটা ভাঙাচোরা মাটির সড়ক আছে। সেটার বিরাট একটা অংশ বর্ষায় তলিয়ে যায়। সড়কটি শুধু শীতের দিনে পায়দলে রাস্তা হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না, বর্ষায় তিতাস নদী ও বিলের প্রবল ঢেউ থেকে বিরামপুর, গাছতলা, বাগমারা, সাদেকপুর, ভারসিলা গ্রামকেও রক্ষা করে। লোকজন ঢেউ থেকে বাড়িঘর বাঁচাতে নদী থেকে টেনে কচুরিপানা সড়ক বরাবর জমিয়ে রাখে। বাঁশ গেঁড়ে, দড়ি দিয়ে এ পানা যাতে ভেসে না যায়, সেই চেষ্টাও করে। এটাকে আরও পোক্ত করতে কলমিলতা, হেলেঞ্চার ঝোপকে এর সঙ্গে ট্যাগ করেন। হঠাৎ করে মস্তু কাকা ‘আইস সব্বোনাশ, আব্বা পানা কেমনে বাড়ছে দেখছোনি!’ কলিমুদ্দিন ভাই গাছতলা গ্রাম বরাবর কচুরিপানার আগ্রাসন দেখে ‘মস্তু, তরাতরি কর! হাইঞ্জার আগেই জালশুকায় ঢুকতে অইব’ বলে তৎপর হন।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর ইমনকে ছইয়ের ওপর উঠতে দেখে কলিমুদ্দিন ভাই ‘ইলা দাদার মতো সাহসী’ বলে প্রশংসা করায় আমি মনে মনে হিংসায় জ্বলে উঠে শপথ করলাম, জালশুকায় এবার অনেক দূরন্তপনা করে আমার সাহস দেখাব!

আম্মা মস্তুকাকাকে কচুরিপানার কী সমস্যা জানতে চাইলে, জবাব দেন কলিমুদ্দিন ভাই ‘যেইদিকে এই পানা আটকায় দুই–তিন রাইতেই বাড়তে থাকে, দুই হপ্তায় দ্বিগুণ হয়; গেরামে ঢুকার পথ বন্ধ হইয়া যায়। গেরামের লোকজন এইডারে জার্মানি কয়।’ পরে দাদার কাছে শুনেছি ১৯৩৭ সনের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে শুধু কচুরিপানার আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে জলাভূমিকে কচুরিপানার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য অঙ্গীকার করা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে বাংলার জলাভূমি আইন যেটা ‘কচুরিপানা আইন’ নামেও পরিচিত ছিল, পাশ হয়। এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম এই পানা নিয়ে কবিতা লিখেছেন—

‘ধ্বংস করো এই কচুরিপানা!

(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুরছানা।।’

(কচুরিপানা)

এত সুন্দর নীলচে-বেগুনি ফুলের কচুরিপানার বদনাম শুনে আম্মা বলেন, ‘গরুকে তো পানা খেতে দেয়; এটা শুকিয়ে চুলা জ্বালাতেও দেখেছি।’

বিলের ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ দেখি মস্তু কাকা পানিতে নেমে হালের চারপাশ থেকে বিভিন্ন জলজলতা টেনে টেনে সরিয়ে হালটাকে হালকা করলেন। এখানে ওনার বুকসমান পানি। ইমন পানিতে নামতে চাইলে আম্মা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ফিউজ হয়ে যায়। পানির ওপর স্রোত নেই বললেই চলে। ওপর থেকে নিচের চলন্ত মাছ, কাঁচ-পোকা, জলজ উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে। কিছুটা সামনেই হালকা লাল, সাদা, নীল শাপলা ফুল দেখতেই আমি চিৎকার করে ইমনকে দেখালাম। আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে ওনারা বাবা-ছেলে হাসতে লাগলেন। শাপলার বড় বড় গোলাকার পাতার ওপর দিয়ে হাট্টিটি, ডাহুক পাখি হেঁটে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়টি বড় ডাঁটাসহ শাপলা ফুল, সঙ্গে গোল ঢেপফল দিয়ে মস্তু কাকা বললেন ‘এইটা খাইতে পারো।’ ভেতরের কালচে বীজগুলো পানসে লাগায় ‘ওয়াক থু’ বলে আমরা ফেলে দিই। আম্মা, ‘মস্তুর বাপ, ঢেপের খই হয় না?’ বলে কলিমুদ্দিন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত মস্তু কাকা ঢেপের খই, মোয়া ইত্যাদি আমাদের খাওয়াবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ‘হালুক খাইছোনি?’ কলিমুদ্দিন ভাইয়ের এ কথায় আমরা বলি ‘শালুক দেখি নাই।’ এক ফাঁকে আলুর মতো কালো শাপলার মূল উঠিয়ে আমাদের হাতে দেন; এটা পুড়িয়ে খেলে নাকি খুব মজা লাগে!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চারপাশে দূরে দূরে অসংখ্য লাল, নীল, হলুদ পালতোলা নৌকা দেখতে পেয়ে আমরা ওনাদের আমাদের পালটা টানিয়ে দিতে অনুরোধ করি। কিন্তু, বিলে বাতাস না থাকায় লগি ঠেলে নৌকা এগিয়ে নেওয়াটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাপ-বেটা মিলে লম্বা একটা বাঁশের টুকরার এক মাথায় দড়ি বেঁধে অন্য মাথাটি পাল টানানোর লম্বা বাঁশের মাথায় বেঁধে গুণ টানার প্রস্তুতি শেষ করেন। মস্তু কাকা বিলের গলা পানিতে নেমে আস্তে আস্তে তীরের দিকে এগোতে থাকেন। আমরা দুজন গলুইয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওনাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। তীরে ওঠে নৌকার সামনের দিকে ঘাড়ে দড়িসহ বাঁশের টুকরাটি ধরে মস্ত কাকা টানতে থাকেন। দড়িটা টানটান হয়ে নৌকা চলতে লাগল। পেশিবহুল মস্তু কাকাকে দেখতে রোমান বীর স্পার্টাকাসের মতো মনে হচ্ছে। আম্মা উনাদের তীব্র শারীরিক পরিশ্রম দেখে আফসোস করতে লাগলেন।

সন্ধ্যায় বাংলাঘর থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে সাত/আট কিলোমিটার দূরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হলদে লাইটগুলো দেখে আমরা আশাবাদী হবার চেষ্টা করি, একদিন আমাদের গ্রামেও বিদ্যুৎ আসবে। কোনো দিন হালকা বৃষ্টি আবার কোনো দিন ভারী বৃষ্টির মাঝেমধ্যে পরিষ্কার আকাশে সন্ধ্যায় সন্ধ্যাতারা দেখতে পেয়ে আমরা দাদিকে ধরি গল্প বলার জন্য। বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যায় মশার উৎপাত আর গরমে আম্মাকে জ্বালাতন করতে থাকি হাত পাখার বাতাস করার জন্য। দাদি আম্মাকে রিলিফ দেওয়ার জন্য আমাদের উঠানে মাদুর পেতে বসতে বলেন। দাদার জন্য হামানদিস্তায় পান ছেঁচতে ছেঁচতে দাদি সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং কোরআন শরিফ পড়ার জন্য আমাদের তাগিদ দেন। আশপাশে ইমন রিনা, রিপা, অপেলের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে চোর পলান্তি খেলছে। গল্পের গন্ধ পেয়ে ওরাও আমাদের সঙ্গে শামিল হয়। ওনার শুরু করা গল্প ‘এক দেশে ছিল একজন বাদশাহ... ’ কোনো দিন পুরোটা শোনা হয় না; চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে। মাঝেমধ্যে দাদিকে উনার ছোটবেলার কথা জিজ্ঞাসা করলে হাসতে হাসতে মোসাম্মৎ উম্মিয়া খাতুন ছোটবেলার জাঁকজমকপূর্ণ দিনগুলোতে ফিরে যান। ওনার বাবা আবদুল গনি মৃধা আশুগঞ্জের পাশে তালশহরে বিশাল বড় বাড়িতে ছয়টি কন্যা সন্তান নিয়ে আনন্দময় জীবন যাপন করেছেন। ব্যবসায়ী আবদুল গনি মৃধা ভৈরব, আশুগঞ্জ, আখাউড়া, ভারতের আগরতলায় প্রচুর স্থাবর সম্পদের মালিক মেয়েদের শিক্ষিত ও বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা দেন। আমরা দাদিকে মাঝেমধ্যে ঢাকার আজিমপুর কলোনির ফেলে আসা বাসার কথা জিজ্ঞাসা করে কোনো আফসোস হয় কি না জানতে চাইলে উনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এই জীবন কয় দিনের? সামনে অনন্তকালের জীবনের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে; লোভ করা যাবে না। তোদের দাদাও নির্লোভ মানুষ, সারাটি জীবন চাকরির কারণে ইউরোপ- আমেরিকায় কাটিয়ে এই বিদ্যুৎহীন গ্রামে চলে এসেছেন মানুষের ভালোবাসার টানে। যে কেউ এসে কোনো কিছু চাইলেই বিনা ওজরে দিয়ে দেন।’ আসলেই তো তাই। বাড়িতে প্রায়ই লোকজন এসে বলে ‘দাদা, অমুকের মা খুব অসুস্থ। একটা ডাব খাইতে ইচ্ছা করছে।’ দাদা বলেন, ডাব পেড়ে নিয়ে যা; কয়টি পাড়ল দেখতেও আসেন না। ‘তোর দাদা আমেরিকার অরিগন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ‘গভর্নর অব অরিগন স্টেট’ ওনাকে ‘অ্যাম্বাসাডর টু পাকিস্তান’ নির্বাচিত করেছিল, দাদি।

ছুটি শেষে কলিমুদ্দিন ভাই আমাদের আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে দেবেন। দাদা-দাদিকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা খুব কষ্টকর। উনারা ঢাকায় যাবেন—থাকতে নয়; ১০-১৫ দিন এর জন্য বেড়াতে বা ডাক্তার দেখাতে। চলে আসার দিন সকাল থেকে দাদা চুপ করে ইজি চেয়ারে বসে থাকেন, শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন। নৌকা ছেড়ে যাওয়ার পর যতক্ষণ দেখা যায় দাদি বাংলাঘরের কোনায় পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। দাদির ঘিয়ে রঙের শাড়িতে চোখ মোছার হৃদয় নিংড়ানো বিদায়টা আজও জালশুকা থেকে ফেরত আসার সময় মানস চোখে দেখতে পাই।

* লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর