রবিনহুড এবং টম সয়ার
আজিমপুর কলোনির ৩৯ নম্বর মাঠের উত্তর পাশ থেকে বাঁকা হয়ে উঠে যাওয়া বিশাল খেজুরগাছটার নিচে আমরা বসে আছি। কণক গাছ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ইমন আর রাজী আলেকজান্ডার ডুমার ‘দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বাতচিত শুরু করে দিয়েছে। রাজী বলছে তিনজন প্রধান মাস্কেটিয়ার, এ জন্যই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। ইমন বলল, ‘না, না, এই বইটির নাম হওয়া দরকার ছিল ফোর মাস্কেটিয়ার্স। কারণ, নায়ক হচ্ছে চারজন- দ্যঁর্তেগা, পার্থোস, আরামিস আর অ্যাথোস।’ তাদের ক্যাচক্যাচানিতে আমাদের কান ঝালাপালা। রাজী অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমার কাছে তলোয়ার থাকলে এখনই তোকে চ্যালেঞ্জ করতাম।’ ইমনও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না, ‘আয়, বিকেলে বাগান থেকে দুটা ডাল দিয়ে তলোয়ার বানিয়ে আনব, তোকে দ্যঁর্তেগার মতো ফাইট দিয়ে টাইট করে দিব।’
আমাদের ছুটি অফুরান। শিডিউল ছুটির বাইরে এরশাদ ভ্যাকেশন থাকে প্রায়ই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের কারণে স্কুল–কলেজ মাঝে মাঝে এক দিন–দুই দিনের জন্য বন্ধ থাকে। আমরা সারা দিন মাঠে খেলি। নতুন নেশা হয়েছে সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্লাসিকগুলো। আমাদের খেলাধুলায় নতুনত্ব আনতে ‘তিন গোয়েন্দা’র মতো মুসা, কিশোর, রবিন সাজি। কখনো কখনো স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘শার্লক হোমস’ হয়ে টিলো এক্সপ্রেস খেলি। লেটেস্ট থ্রি মাস্কেটিয়ার্স আর মার্ক টোয়েনের টম সয়ার ও হাকলবেরি ফিনে আমরা মজেছি। সবাই টম সয়ার আর হাকলবেরি ফিন হতে চায়। ইমন নাক সিঁটকে বলে, ‘টম সয়ার-হাকলবেরি ফিন হতে হলে আশপাশে নদী আর জঙ্গল থাকতে হবে; আমাদের গ্রামের বাড়ি জালশুকায় মিসিসিপি নদীর মতো পাগলা নদী আছে। কাজেই আমরা দুই ভাই টম সয়ার আর হাকলবেরি ফিন।’ মাঝে মাঝে বন্ধুরা মেনে নেয়, আবার অনেক সময় ঘুষাঘুষি–কিলাকিলির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়।
আম্মা প্রচুর বই পড়েন। কিন্তু এগুলো ভারত লেখকদের বই আর পুজো সংখ্যার মোটা মোটা ভলিউম। নটর ডেম কলেজের ছাত্র লীপু ভাই মাঝে মাঝে সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক বই নিয়ে আমাদের বাসায় পত্রিকা পড়তে আসেন। আমরা ভয়ে পেপারব্যাকের দিকে নজর দিই না। এগুলো নাকি ছোটদের পড়তে নেই। মাসুদ রানাসহ সব বই–ই নাকি বড়দের পাঠ্য। আমাদের দৌড় নীল কমল, লাল কমল, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, ডালিম কুমার, ঠাকুরমার ঝুলি পর্যন্ত। একদিন লিপু ভাইয়ের হাতে তিনটি ছেলের ছবিসহ তিন গোয়েন্দা বইটা দেখার পর ইমন জিজ্ঞেস করল, ‘এই বইয়ে ছোট ছেলেদের ছবি কেন?’ লিপু ভাই হেসে বললেন, ‘তোমাদের বয়সের তিনটা ছেলে আমেরিকায় গোয়েন্দাগিরি করে। তোমরা এটা পড়তে পারো।’ লিপু ভাই আমাদের কিশোর ক্লাসিকের নেশা ধরিয়ে দেন। আম্মা মাঝে মাঝে বইগুলো সেন্সরশিপে পাঠিয়ে দেখতেন। পরে পাশের বাসার রাখি আপাদের কাছ থেকে ‘কুয়াশা’ সিরিজের বইগুলো মাঝে মাঝে এনে দিতেন।
পড়ার দ্রুতগতির জন্য লিপু ভাইও মাঝে মাঝে বই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। বুদ্ধি দিলেন, ‘লালবাগের মদিনা হোটেলের কাছাকাছি লালবাগ লাইব্রেরিতে গেলে অনেক বই পড়তে পারবে।’ আমাদের একেকটি বই হাত বদল হয়ে সার্কেলের সব বন্ধুরা চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত লোটাস ভাই একদিন বুদ্ধি দিলেন, ‘তোমরা নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের মার্কেট থেকে বই কিনতে পারো তিন ভাগের এক ভাগ দামে।’ আমাদের কাছে এত পয়সা কই? কিন্তু তত দিন আমরা কেউ ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রসো হয়ে নির্জন দ্বীপে কল্পনায় ঘুরে বেড়াই, কেউবা হাওয়ার্ড পাইলের ‘রবিনহুড’ হয়ে হাতে তির–ধনুক নিয়ে কলোনির বাগানকে শেরউডের জঙ্গল মনে করে ঘুরে বেড়াই।
পড়ার নেশা মারাত্মক। আম্মা প্রচুর বই পড়তেন, আব্বাও এ ব্যাপারে বাধা দিতেন না। ‘ফাইভ স্টার’ ক্লাবের আমাদের বন্ধুরা ঠিক করলাম টিফিনের পয়সা জমিয়ে সেবা প্রকাশনীর বই কিনব। কারও বাসায় চার আনা, কারও বাসায় দশ পাই-আট আনা বরাদ্দ আবার কারও কোনো বরাদ্দই নেই। ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল একেবারে আমাদের ৩২ নম্বর ভবনের সাথে। এ জন্য দুপুরে টিফিন আওয়ারে দৌড়ে বাসায় ভাত খেয়ে যাই। অনেক সময় বরাদ্দ মঞ্জুর হয়, অনেক সময় নামঞ্জুর। পকেটে পঁচিশ পয়সা থাকলে আরও পঁচিশ–এর দিকে নজর। আট আনা জমাতে পারলে মামুর হালিম খাওয়া যাবে। পুরো সপ্তাহেও একেকজনে চার আনা জমাতে পারে না—কোনো দিন বাদাম, কটকটি, কোনো দিন চালতার আচার, বেত ফল, চটপটি; আবার কখনো বাদামপাপড়ি, আইসক্রিম, হাওয়াই মিঠাইয়ের লোভে। প্রতি বৃহস্পতিবার যে যার জমানো পুরো সপ্তাহের সম্পদ নিয়ে এক জায়গায় গোল হয়ে বসি। সব মিলিয়ে ৫ টাকা ৬ টাকা হলেই কেল্লাফতে। সেবা প্রকাশনীর নতুন বইয়ের দাম ৮ টাকা থেকে শুরু করে ১২ টাকা পর্যন্ত। তিন ভাগের এক ভাগ ধরে দুটি বই কিনতে পারি। বৃহস্পতিবার বা শনিবার খালি পায়ে বগলে ফুটবলসহ নীলক্ষেতের পুরোনো বইয়ের দোকানে আমাদের ফাইভ স্টারের দুই–তিনজন প্রতিনিধি হাজির হই।
আব্বার সহকর্মী ফরিদা খালা আমাদের কাছাকাছি বিল্ডিংয়ে থাকেন। উনার ছেলে বাবুকে আঙ্কেল আর ফরিদা খালা সমানে বই-কমিকস কিনে দেন। ওদের বাসায় গেলে বাবুর কাছে বাহাদুর, চাচা চৌধুরী, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা, মেন্ড্রক, ফ্যান্টমের অফুরন্ত সম্ভার দেখে আমাদের মাথা নষ্ট হওয়ার জোগাড়। ওর কাছে একটা কমিক্স বই চাইলে চার-পাঁচটা দেয়। এই বই আবার আমাদের সার্কেল থেকে অন্য সার্কেলে ঘুরে আরও অনেক বই আমাদের হাতে নিয়ে আসে।
বিকেলে অবসরে আমরা বসে বসে আলাপ করি-কে কী হতে চায়? তত দিনে ফরাসি লেখক জুলভার্নের আমরা মস্ত ভক্ত হয়ে গেছি। একজন মানুষ একটি চিলেকোঠায় বসে কীভাবে ভবিষ্যতের গল্প লিখতে পারে, এটা আমাদের অনেক অবাক করত। ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’র ফিলিয়াস ফগ চরিত্রকে আমরা মনেপ্রাণে ধারণ করতে চাইতাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম যদি নির্জন কোনো দ্বীপে কখনো আটকে পড়ি তাহলেও চিন্তা নেই, ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’–এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা নিশ্চয়ই ওভারকাম করতে পারব। তখন নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন নিমোর সাবমেরিন নটিলাসের দেখা পাব। টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলাকে তখন মনে হতো বাচ্চাদের খেলা। বন্ধু মাহবুব বলল, ‘আমরা তো সিমেন্টের পিচে কর্কের বল দিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারি, পিচ তো আমাদের বত্রিশ নাম্বার মাঠের মাটির নিচেই আছে।’ আসলেই তা–ই। পাশে নতুন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের সময় সিমেন্টের পিচ ঢাকা পড়ে গেছে সুরকি আর বালুতে। ‘চলো, পিচ খনন করি’ বলে কোদাল-শাবল নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। সোহেল, ইমন, বাবু, মাহবুব সবাইকে দেখে মনে হতো হেনরি রাইডার হেগার্ডের ‘সলোমনের গুপ্তধন’ আবিষ্কার করতে আমরা নেমেছি।
অফ চান্সে একদিন রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের একটি বই পড়তে গিয়ে আম্মার হাতের কানমলা আর পিঠে দমাদম কিল হজম করতে হয়েছে। কাজী মাহবুব হোসেনের ওয়েস্টার্ন সিরিজের বইগুলোর এরফান জেসাপ, রাইডার চরিত্রগুলো আমাদের অতি শিশু বেলায় টেলিভিশনে দেখা ‘ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’–এর হারানো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বেল্টের পাশে মোজা, কাপড়, বাঁশপাতা কাগজের হোলস্টার বানিয়ে খেলনা পিস্তল নিয়ে কে কত দ্রুত ড্র করতে পারি, তা অন্যদের চ্যালেঞ্জ করি।
বাংলা সিনেমার নায়ক আর ভিলেনের বাইরেও যেমন ট্র্যাজেডি নায়কের পার্ট থাকে তেমনি কিছু কিছু বইয়ের প্রধান চরিত্রদের না পাওয়া এবং হেরে যাওয়া আমাদের চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারত না। ভিক্টর হুগোর ‘হাঞ্চব্যাক অব নটরডাম’–এর ক্যাথেড্রাল টাওয়ারের পাশে কুঁজো কোয়াসিমোডো আর নর্তকী এসমেরালডার করুণ কাহিনি খুব কষ্ট দিয়েছে। বইয়ের শুরুর দিকে যে কোয়াসিমোডো ছিল, আমাদের চোখে ভিলেন সে হয়ে যায় ট্র্যাজেডি হিরো। একজন জন্মগত বিকলাঙ্গ মানুষও কীভাবে একটি বইয়ের প্রধান চরিত্র হয়ে যায়, সেটা অনেক সময় চিন্তা করতাম। ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’ বইটি আম্মা পড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। একজন অনাহারি মানুষ জঁ ভালজঁ শুধু একটি রুটি চুরির কারণে সাড়ে চার বছর জেল খাটার শাস্তি পেয়ে শেষ পর্যন্ত উনিশ বছর সাজা খেটে বের হয়েছেন—পড়ে খুব কষ্ট লেগেছিল। সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর অপমানে শহরের ড্রেনে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হতো। যে শেষ পর্যন্ত অন্য আরেকজনকে বাঁচাতে আবারও জেলে যায়। এই পর্যায়ে তীব্র কষ্টে বুক ভেঙে গিয়েছিল।
রাজা–বাদশাহ হলে মন বড় হতে হয়—এই ধারণা ভেঙে গিয়েছিল আলেকজান্ডার ডুমার ‘ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক’ বইটি পড়ে। ফ্রান্সের অত্যাচারী রাজা চতুর্দশ লুই তার নিজের যমজ ভাইয়ের মুখটা লোহার মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখার যখন আদেশ দেয়, তখন মনে হয়েছিল ভাই হয়ে ভাইকে এমন শাস্তি দিতে পারে কেউ? আব্বা ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। উনাকে এই চরিত্র সম্পর্কে বলতে জানান মোগল সম্রাটদের অনেকে, তাদের ভাইদের সাথে এই ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন।
লিপু ভাইয়ের হাতে খুলির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ফুলের ছবিওয়ালা ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালবাসা (এ টাইম টু লিভ এ টাইম টু ডাই)’ বইটি দেখে প্রচ্ছদের শক্তি বুঝতে পারি। এরিক মারিয়া রেমার্কের এই বই এবং ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বই দুটি পড়ে আমাদের ওয়েস্টার্ন বই পড়া, তলোয়ার ফাইট করা মননে তীব্র ধাক্কা এসে পড়ে। ‘যুদ্ধের প্রথম বোমাটি এসে পড়ে হৃদয়ে’ এই কথাটি তখনই বুঝতে পারি। আর্নেস্ট গ্রেভার আর পল বোমার–এর মতো সদ্য তরুণদের স্বপ্ন ধ্বংস হতে দেখে অনেক কষ্ট পেয়েছি।
মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’তে সান্তিয়াগো বুড়োই নায়ক। গভীর সমুদ্রে এক একটা হতাশাজনক দিন কীভাবে সান্তিয়াগো কাটায়, সেটা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। বইটির শ্লথগতির কারণে ইমন ১০–১৫ পাতা পড়ে সারেন্ডার করে। ধৈর্যের পুরস্কার বিশাল বড় মারলিন মাছ শিকার করার মাধ্যমে সান্তিয়াগো বুড়ো পায়। হাঙরের আক্রমণে
আস্তে আস্তে মাছটির আয়তন কমতে থাকায় মনে হয়েছিল সব সময় বড় কিছু পেলেও কপালে না থাকলে সেটা ভোগ করা যায় না। রবার্ট লুই ষ্টিভেনসনের ‘ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইড’ মানুষের ভিতরের মানুষকে চিনিয়ে দেয়। নোংরা, কদর্য, নীচ মিস্টার হাইড সমাজের একই মানুষের বিভিন্ন রূপ উন্মোচন করে।
বইয়ের প্রতিবাদী রবিনহুড থেকে শুরু করে নিঃসঙ্গ ক্যাপ্টেন নিমো, সান্তিয়াগো বুড়ো; চিরদুঃখী জঁ ভালজঁ, কোয়াসিমোডো; স্বপ্নভঙ্গের পল বোমার, আর্নেস্ট গ্রেভার; ভবঘুরে হাকলবেরি ফিন; হার না মানা ফিলিয়াস ফগ, দ্যঁর্তেগার জন্য আজো মন কাঁদে। আমাদের আশপাশের অনেককে চতুর্দশ লুই-এর মতো নিষ্ঠুর আর মিস্টার হাইডের মতো হীন, নোংরা, শয়তান মানুষগুলো চিনিয়েছে।
*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর