খণ্ডকালীন চাকরি ও বাস্তব অভিজ্ঞতা—পর্ব ২
শামীমের প্রশ্নে নির্বিকার ও নির্লিপ্ত ছিলাম। বেলা তিনটা গড়িয়ে গেছে। চাকসু–সংলগ্ন জারুলতলার ঝুপড়িতে বসে তাঁর সঙ্গে চা নিচ্ছিলাম। শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশ দলে দলে শাটল ধরার জন্য স্টেশনের পথে এগোচ্ছে। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা যার যার গন্তব্যে ফিরে লাঞ্চ করে কেউ কেউ ভাতঘুম দিচ্ছে। সাধারণত শামীমরা অন টাইমে ঝুপড়ির বেঞ্চগুলোয় বসেন না। প্রচলিত চর্চায় স্যার ও কর্মচারী তো একসঙ্গে বসতে পারেন না!
এখন অফ টাইম। তাই এই চান্স।
পড়ন্ত বিকেলের শুরুতে জারুলতলার কলকাকলি ফিকে হয়ে গেছে। কোনো কোনো প্রেমিক যুগল একটু নীরবতার সুযোগে ঝুপড়ির কোনায় কিংবা জারুল ফুলের বিছানায় অথবা আর্টস ফ্যাকাল্টির ফাঁকা ক্যাফেটেরিয়া ও চাকসু বিল্ডিংয়ের দক্ষিণে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির লেকের পাড়ে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টায় রত।
ক্লাস শেষ হয়েছে বেলা ১টা ১০ মিনিটে। তারপর দুই ঘণ্টা ডিউটি করে ক্লান্তি লাগছিল। কী মুসিবতই না ছিল। আজ অবশ্য সকালেও এক ঘণ্টা ডিউটি করেছি। কারণ, সকালের ক্লাসগুলোয় তেমন আগ্রহ পেতাম না। একে তো ছিল এম এন আই স্যারের (কিছুটা মানসিকভাবে অ্যাবনরমাল ছিলেন) ক্লাস, তার ওপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের আনলিমিটেড ও একপক্ষীয় আলোচনা। আমার লাইফের অন্যতম ডিস্টার্বিং কোর্স ছিল সেটা। ওই সুযোগে সকালে এক ঘণ্টা ডিউটি করতাম।
আহা! এতক্ষণ আমার তো সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু নতুন কোর্সের দেশি–বিদেশি বইয়ের ক্যাটালগ তো নোট করিনি। উঠি। আনমনে হাঁটতে থাকি আর ভাবি, সপ্তাহে গড়ে ১০ ঘণ্টা ডিউটি করে মাসে ৬০০ টাকা ইনকাম! ভেরি স্যাড!
কিন্তু শামীমরা আমাকে স্নেহ করতেন।
তাঁদের মেসের মধ্যে আমার জন্য প্রতিদিন এক প্লেট বিরিয়ানি (আট টাকা মাত্র) বরাদ্দ রাখেন।
তাঁদের অন্য এক সহকর্মীর বাচ্চাকে বাসায় গিয়ে পড়ানোর অনুরোধ করেন। প্রথমে না করেছিলাম। কেন জানেন?
শামসুন নাহার হলের পেছনের কলোনিতে পড়াতে যেতে হবে। আচ্ছা বলুন তো, লেডিস হলের সামনের গেট পার হয়ে পড়ন্ত বিকেলে ওই পাহাড়ের কলোনিতে যাওয়া সম্ভব? বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র ও জুনিয়রদের ফাঁকি দিয়ে যাওয়া কী করে সম্ভব?
যাহোক, উপায় পেয়ে গেলাম। আমার যাতায়াত ছিল কাটা পাহাড় দিয়ে গোপন একটা রাস্তায়। অনিরাপদ কিন্তু নিরাপদ!
পরিবারটির আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হতাম। মনে হতো, বাসার সবাই আমার সঙ্গে পড়ছে। অপ্রয়োজনীয় হট্টগোল বা ছোট বাচ্চার কান্নাকাটি আমাকে কোনো দিন শুনতে দেয়নি। সন্ধ্যার আপ্যায়ন ছিল যথেষ্ট। যেমন শিঙাড়া, পেঁয়াজু, পুরি, বাংলা কলা, বানরুটি, সবজির বড়া ইত্যাদি। আর চা ছিল কমন মেনু।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
একদিন ছাত্র–সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম সেন্ট্রাল লাইব্রেরির পাদদেশে। কিছু সময় পরে সেন্ট্রাল মিউজিয়াম গেটের পশ্চিমে। যেখানে বসলে চাকসু বিল্ডিং পুরোটাই নজরে আসে।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রতি ঘণ্টায় মজুরি ৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণের দাবিতে চাকসু পরিচালকের দপ্তরে আমরা যৌথ স্বাক্ষরিত আবেদন করব। নিষ্পত্তি না হলে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে যাব। সহ–উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলব। অবশ্য আমাদের বিনয়, সততা ও দাবির সপক্ষে যথার্থ যুক্তি উপস্থাপনার কারণে পরিচালকের দপ্তরেই সেটি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। চলবে...
লেখক: এম এ সালেক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা, কর্মসংস্থান ব্যাংক