বিশ্ব ইজতেমায় আমার তিন দিন–২
ভিড় ঠেলে গেলাম অজুখানার কাছে। সেখানেও একই অবস্থা। সেদিন আমি জামাতে নামাজ পড়ার আশাটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটু সুযোগ পেয়ে ওজু সেরে কাছের একটা জায়গায় নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজটা জামাতেই পড়ার সুযোগ পাই। এর পর থেকে নামাজের অনেক আগে অথবা একবারের ওজু দিয়ে একাধিক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে নিই। এভাবে ওজু–এস্তেঞ্জার ভিড় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। রোববার ফজরের নামাজের ওজু–এস্তেঞ্জার জন্য রাত তিনটার দিকেই উঠে পড়ি। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ওজু–এস্তেঞ্জার জন্য যেতে হয়। যাহোক এরপর বাকি সময়টায় আর ঘুমাইনি। নফল ইবাদত, জিকির ও দোয়া করে সময়টা কাটিয়ে দিয়েছি। এরপর ফজরের নামাজের সময় হলে জামাতে শরিক হয়েছি।
আসলে বিশ্ব ইজতেমা মানে টঙ্গীর ময়দানে শুধু তিন দিন কাটিয়ে দেওয়া নয়। এর নেপথ্যে আছে অনেক কিছু। বিশ্ব ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তাঁর সংসার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর রাস্তায় বের করা, যেখানে গিয়ে তাঁরা আল্লাহর দেওয়া জান, মাল ও সময়ের সহিহ ব্যবহার শিক্ষা করে বাড়িতে এসে সাংসারিক জীবনে ও নিজ মহল্লায় এ শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ অব্যাহত রাখবেন এবং নিজ মহল্লার মসজিদওয়ালা কাজে আমৃত্যু জুড়ে থাকবেন। আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়াটা হতে পারে এক চিল্লার (৪০ দিনের) জন্য, তিন চিল্লার জন্য, এক বছরের জন্য অথবা আরও বেশি সময়ের জন্য। অনেকেই আবার পাঁচ মাস বা আরও বেশি সময়ের জন্য বিদেশে সময় লাগানোর জন্য বের হন। আবার অনেকেই মাস্তুরাতসহ (মহিলা) দেশ–বিদেশে সময় লাগানোর জন্য বের হন।
উল্লেখ্য, একজন পুরুষ তাঁর মা, স্ত্রী, মেয়ে বা বোনকে নিয়ে কেন্দ্রীয় মারকাজের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে আল্লাহর রাস্তায় বেরোতে পারেন। বিশ্ব ইজতেমা থেকে যাতে জামাত বেরোতে পারে, সে জন্য সারা দেশের তাবলিগের জিম্মাদার সাথিরা ইজতেমা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই অসাধারণ পরিশ্রম করে থাকেন। একবার ভেবে দেখুন, বিশ্ব ইজতেমায় আসা একজন মানুষকে হঠাৎ করে এক চিল্লা বা তিন চিল্লার জন্য বের হতে বললেই কিন্তু বের হয়ে যাবেন না। তাঁর জন্য এসব লোকের পেছনে দীর্ঘদিন চেষ্টা করতে হয়। জিম্মাদার সাথিরা তাঁদের নিজ নিজ মহল্লার লোকদের আল্লাহর রাস্তায় বের করার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর চেষ্টা করে থাকেন। কারও ক্ষেত্রে সফল হন। আবার কারও ক্ষেত্রে সফল হন না। কিন্তু কখনো তাঁরা হতোদ্যম হন না। দেশ–বিদেশ থেকে আসা তাবলিগ জামাতগুলোও চেষ্টা করে মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় বের করার জন্য। কেউ যদি নগদ বের হয়ে যান তো ভালো। আর যাঁরা পারেন না, তাঁদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বের হওয়ার জন্য নিয়ত করতে অনুরোধ করা হয়। বিশেষ করে অনেকেই বিশ্ব ইজতেমা থেকে বের হওয়ার নিয়ত করেন। তাঁদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ইজতেমায় নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমার ৪০ দিন পূর্বে ঢাকায় পাঁচ দিনের জোড় হয়। এই জোড়ে সারা দেশের তাবলিগের জিম্মাদার সাথিরা অংশ নেন। তাঁদের কাছ থেকে তাবলিগের কাজের কারগুজারি শোনা হয় এবং কাজকে আরও বেগবান করার জন্য নতুন তাকাজা পেশ করা হয়। এই জোড় থেকেই সাথিরা জামাতবন্দী হয়ে দেশ–বিদেশে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁরা দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে ইজতেমার দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান এবং মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় বের করার জন্য তৈরি করে ইজতেমায় নিয়ে আসেন। ইজতেমায় প্রতিদিন দীর্ঘ সময় বয়ান হয়। এসব বয়ানের মূল উদ্দেশ্যই থাকে মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় বের করার জন্য অনুপ্রাণিত করা। বয়ানের পর তাশকিল করে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে ইচ্ছুক মানুষকে জামাতবন্দী করা হয়। এভাবেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে প্রতিবছর মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় সময় দেওয়ার জন্য বের করা হয়।
এ বছর দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশ্ব ইজতেমায় চৌষট্টিটি দেশের লোক সমবেত হন। ইজতেমা থেকে নগদ তিন চিল্লার জামাত হয় ১৩০টি, এক চিল্লার জামাত হয় ২৯৩০টি, বিভিন্ন দিনের (১০ দিনের, ২০ দিনের ইত্যাদি) জামাত হয় ৮০টি, বিদেশে যাওয়ার জন্য পুরুষ জামাত হয় ৪৭৪টি, মাস্তুরাতসহ বিদেশে যাওয়ার জন্য জামাত হয় ১৯০টি। বিদেশি জামাত এসেছে ৩১৪টি। মোট ৯১১০ জন বিদেশি মেহমান বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। (সূত্র: মালওয়ালি মসজিদ, কাকরাইল, রমনা, ঢাকা।) এ বিশাল জমায়েত সম্ভব হয়েছে তাবলিগের ত্যাগী সাথিদের বিশ্বব্যাপী পরিশ্রম ও কোরবানির ফলে। তাঁরা যে কতটুকু পরিশ্রম করেছেন তা কাছে থেকে না দেখলে শুধু বলে বোঝানো কঠিন।
২১ ডিসেম্বরে রোজ শনিবার ছিল বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন। এদিন ফজরের বয়ানের পর নিজ নিজ কিত্তায় তালিম শুরু হয়। তালিমের একপর্যায়ে জানা গেল যে আমাদের এখানে বিদেশি মেহমান আসবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদেশি মেহমান এলেন। এদিন বিভিন্ন দেশের বিদেশি মেহমানগণ বিভিন্ন কিত্তায় গিয়ে অনেকক্ষণ বয়ান করে মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ায় জন্য অনুপ্রাণিত করলেন। যাঁরা বিদেশ থেকে আমাদের দেশে অথবা আমাদের দেশ থেকে বিদেশে যান, তাঁরা নিঃসন্দেহে তাবলিগের খুব ডেডিকেটেড মানুষ। তাঁদের কথায় গায়েবি শক্তি থাকে। তাই তাঁদের কথায় মানুষ প্রভাবিতও হন বেশি। তাঁদের কথাবার্তা শুনে আমাদের কিত্তারও অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় বেরোনোর জন্য নাম লেখান, যাঁদের অনেকেই ইজতেমা শেষে বেরও হয়ে যান।
ইজেতমার তৃতীয় দিন
২২ জানুয়ারি রোজ রোববার ছিল বিশ্ব ইজতেমার তৃতীয় ও শেষ দিন। এদিন ফজরের নামাজের পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বয়ান হয়। বয়ানের পর দীর্ঘক্ষণ হয় হেদায়েতের কথা হয়। হেদায়েতের কথার পরে দুপুর ১২টা ১৬ মিনিটে শুরু হয় আখেরি মোনাজাত। এ মোনাজাত শেষ হয় দুপুর ১২টা ৪৬ মিনিটে। মোনাজাত পরিচালনা করেন সাদ কান্ধলভী (দা. বা.)–এর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী(দা. বা.) । মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় দোয়ার সময় টঙ্গীর তুরাগতীর ও আশপাশের এলাকায় ঢল নামে লাখো মুসল্লির। দোয়ায় শরিক হওয়ার জন্য তাবলিগার ছাড়াও অগণিত সাধারণ মানুষের আগমন ঘটে আগের দিনের সন্ধ্যা বা রাত থেকেই। প্রতিবারের মতো এবারও দোয়ার সময় টঙ্গীর তুরাগতীর ও এর চারপাশটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। যাহোক ৩০ মিনিটের এ দোয়ার সময় টঙ্গীর তুরাগতীর ও আশপাশের এলাকায় এক আবেগ ঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। লাখো মানুষের কান্না আর আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠে পুরো এলাকা ও এর আশপাশ। মোনাজাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি, সব রকমের পাপ থেকে মুক্তি, রোগব্যাধি থেকে মুক্তি, ইহকাল ও পরকালের শান্তি ও কামিয়াবি, দেশ ও দশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মার ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনা করা হয়। এ মোনাজাতে অংশ নিতে পেরে কতটা যে ভালো লেগেছে, তা বলে বোঝাতে পারব না। এই মোনাজাতের মাধ্যমেই এবারের বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।
১৯৬৭ সালে টঙ্গীর ময়দানে বিশ্ব ইজতেমার যে বীজ বপন করা হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় আজ তা মহিরুহে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমার সুনাম এখন এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা, পানি, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়ে ইজতেমার সফলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সরকার। এতে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের সক্ষমতার ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হচ্ছে।
বিশ্ব ইজতেমার ব্যবসায়িক/অর্থনৈতিক দিকটাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ না। এ সময় টঙ্গীর বাজার অর্থনীতি থাকে একেবারেই চাঙা। বিশেষ করে মাছ, গোস্ত ও কাঁচা তরিতরকারি দোকানদারেরা ক্রেতাদের চাপে হিমশিম খায়। এই কদিনে তাঁরা যে ব্যবসা করেন, তা হয়তো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। অন্যান্য দোকানের বেচাকেনাও এ সময় চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া ইজতেমা উপলক্ষে সারা দেশের পরিবহন খাতে থাকে চনমনে ভাব।
যা না বললেই নয়
আর একটা বিষয় না বললেই নয়। এটা হলো ইজতেমায় দেশ–বিদেশ থেকে আসা মানুষের একে অপরের প্রতি যে রকম সহযোগিতা আর সহমর্মিতা দেখা যায়, তা হজ্জ ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া কঠিন। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে নিজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্যকে টয়লেটে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, অন্যকে ওজুর পানি দিয়ে সাহায্য করা, কেউ রাস্তা হারিয়ে ফেললে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া, টয়লেট পরিষ্কার করে দেওয়া (এ কাজটা অনেকেই করেছেন। তবু একটা উদাহরণ দিই। আমি ইজতেমার দ্বিতীয় দিন টয়লেট বিল্ডিংয়ে গিয়ে দেখি ৮–১০ জন লোক বিল্ডিংয়ের নিচতলার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে সব কটি টয়লেট হারপিক আর স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে মুছে পরে কলাপসিবল গেট খুলে দিয়ে দোতলায় গিয়ে একই কাজ করেন। এরপর আমি চলে আসি। আমার মনে হয়, তাঁরা তিনতলার টয়লেটগুলোও একইভাবে পরিষ্কার করেছেন। লোকগুলোর চেহারা দেখে যে কেউ বুঝবে তাঁরা সুইপার না। তাঁরা সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ), নিজের বিছানার ওপর দিয়ে অন্যদের অবাধে যেতে দেখলেও কিছু না বলা—এসব ঘটনা ইজতেমায় খুব সাধারণ বিষয় ছিল। এক কথায় ইসলামি ভ্রাতৃত্ব বোধ বলতে যা বোঝায়, তার সবই ইজতেমায় পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে এটা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। কেবল মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই যে সবাই এগুলো করেছেন, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্ব ইজতেমায় যারা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের বেশ কষ্ট হয় এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড শীতের রাতে মাঠে শুয়ে থাকা, অনেক দূর হেঁটে গিয়ে টয়লেটের লাইনে দাঁড়ানো, প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ওজু–গোসল করা—সবই একটু কষ্টকর তো বটেই। কিন্তু পরকালের ভয়াবহ শাস্তি থেকে বাঁচা আর বেহেশতের মতো চিরস্থায়ী শান্তির জায়গা লাভ করা, সর্বোপরি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য এ কষ্টটুকু একেবারেই নগণ্য। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে এ কষ্টটা একটু বেশি মনে হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যাঁদের এ কষ্টের স্বাদ বোঝার তৌফিক দিয়েছেন, তাঁরা নিজেদের সংসারকে পেছনে রেখে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আল্লাহর রাস্তায় থেকে আল্লাহর বড়ত্বের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কষ্টটাকে কষ্টই মনে করেন না। তাঁদের কোরবানির ফলেই আল্লাহ তাআলা আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে দিনের ছোটখাটো কাছে লেগে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা এসব কোরবানিওয়ালা সাথিদের সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অল্পস্বল্প কাজকে কবুল করে নিন এবং বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী সব মানুষসহ মুসলিম উম্মাহর ইহকাল ও পরকালের সার্বিক সফলতা ও কল্যাণ দান করুন। আমিন
*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোণা