বিশ্ব ইজতেমায় আমার তিন দিন–১
বিশ্বের অন্যতম বড় ধর্মীয় সমাবেশ টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে ১৯৬৭ সালে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা হয়। প্রতিবছর এ বিশ্ব ইজতেমা হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই বছর এটা হতে পারেনি। তাই এবারের ইজতেমা নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই ইজতেমায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা আমার ছিলই। কিন্তু সময় করে উঠতে পারব কি না, এ আশঙ্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। এমনিতেই একটা ডাবল শিফট স্কুলের দায়িত্ব। তার ওপর জানুয়ারি মাস। কাজের চাপের কোনো শেষ নেই।
তার চেয়েও বড় কথা, আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়াটাই একটা বিশাল ব্যাপার। কারণ, কেউ যদি মহান আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় বেরোনোর ইচ্ছা করেন, তাঁর ওপর শয়তান এত বেশি মেহনত করা শুরু করে যে তাঁর বাড়ি ছেড়ে বের হওয়াটাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ছাড়া মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেও কিছু পরীক্ষা আসে।
আমার এবারের ঘটনাটা একটু বলি। ১৯ জানুয়ারি রাত ১২টার বাসে আমাদের ঢাকার উদ্দেশে রওনা করার কথা। টিকিটও কনফার্ম। উনিশ তারিখ দুপুরে আমার মেয়ে ফোন করল। আমি তখন মোহনগঞ্জে, আমার স্কুলে। মেয়ে বলল যে আমার স্ত্রীর বুকে–পিঠে বেশ ব্যথা। আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে হবে। কিন্তু স্কুলে আমার খুব জরুরি কিছু কাজ ছিল, যেগুলো ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি আসার কোনো সুযোগ ছিল না। স্ত্রীকে বললাম, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার জন্য।
সে তা–ই করল। ডাক্তার ওকে দেখে তিনটা ইনজেকশন করতে বললেন এবং ইসিজি করাতে বললেন। তিনটা ইনজেকশন দিতে হবে শুনে স্ত্রী বেশ ভয় পেয়ে গেলেন এবং ইনজেকশন ও ইসিজি কোনোটাই না করে বাসায় চলে এল। আমি বিষয়টা শুনে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। এমনিতেই ওর উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আছে। তাঁর ওপর ইনজেকশন ও ইসিজি না করে চলে আসা। একটু চিন্তায়ই পড়ে গেলাম। ফোনে কিছু ওষুধ খেতে বললাম।
এরপর স্কুলের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে বিকেলের মহুয়া ট্রেনে মোহনগঞ্জ থেকে নেত্রকোনার উদ্দেশে রওনা দিই। ট্রেনে উঠে ভাবছিলাম যে ইজতেমায় হয়তো যাওয়া হবে না। কারণ, হৃদ্রোগ–বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেই অনেকগুলো টেস্ট দেবেন যেগুলোর ফল এক দিনে পাওয়া না–ও যেতে পারে। এ ছাড়া আমার স্ত্রীর অবস্থা আরও একটু খারাপ হলে হয়তো ময়মনসিংহেও নিয়ে যেতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইজতেমায় না যেতে পারার যথেষ্ট কারণ আছে।
এতসব চিন্তার মধ্যে হঠাৎ মনে হলো মহান আল্লাহ তায়ালা না চাইলে তো আমি ইজতেমায় যেতে পারব না। আর আল্লাহ তায়ালা চাইলে আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন। তাই আল্লাহর কাছে চাইলাম।
এসে আমার স্ত্রীর অবস্থা জানতে চাইলাম। ও বলল, আগের চেয়ে ব্যথাটা অনেকটাই কমে গেছে। ওর কাছে জানতে চাইলাম আমি ইজতেমায় যাব কি না। ওর মতো যাওয়ার পক্ষেই। আমিও মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং তাঁর ওপর ভরসা রেখে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে ইজতেমার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম। আমি দেখেছি, তাবলিগে যাওয়ার আগে সব সময়ই কোনো না কোনো বাধার সম্মুখীন হই।
তবে নিয়ত শক্ত করে ফেললে সমস্যাগুলোর সমাধানও কোনো না কোনোভাবে হয়েই যায়। যা হোক, যাওয়ার আগে স্ত্রীকে কিছু ওষুধ খাওয়ার জন্য দিয়ে গেলাম। এসব ওষুধ আমার ঘরে থাকেই। ইজতেমা থেকে ফিরে এসে দেখলাম, আল্লাহর রহমতে আমার স্ত্রীর তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবু ওষুধগুলো আরও কিছু দিন চালিয়ে যেতে বললাম। আল্লাহর রহমতে ও এখন ভালোই আছে। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞতা।
১৮ জানুয়ারি রাতে আমাদের জামাতের সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে বাসে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার উদ্দেশে রওনা দিই। আমাদের বাস ছাড়ে রাত ১২টায়। আমরা টঙ্গীর বাটা গেটের উল্টো পাশে গিয়ে নামি ১৯ ডিসেম্বর ভোর চারটায়। সেখান থেকে মালপত্র মাথায় নিয়ে হেঁটে ইজতেমার ময়দানে পৌঁছাই ৪টা ৩০ মিনিটে। এরপর ময়দানে আমাদের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় বিছানা পেতে বিশ্রাম করার তেমন একটা সুযোগ পেলাম না।
ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতির জন্য বের হতে হলো। এস্তেঞ্জা ও ওজুর স্থান বেশ দূরে থাকায় এস্তেঞ্জা ও ওজু সেরে আসতে আসতেই ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেল। বিশাল জামাতে ফজরের নামাজের তৃপ্তিই আলাদা। মন–প্রাণ একেবারে ভরে গেল। যাহোক নামাজের পর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে ইজতেমার মূল কাজ শুরু হলো।
আমাদের মসজিদের জামাতের আগেই অগ্রবর্তী দলের কয়েকজন দুই দিন আগেই ইজতেমার মাঠে চলে যান। তাঁরা নেত্রকোনার খিত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত জামাতের দায়িত্বে ছিলেন। এ বছর সারা ইজতেমার ময়দানকে ৮৫টি খিত্তায় ভাগ করা হয়। আমাদের নেত্রকোনার খিত্তা নম্বর ছিল ৪৯। যাহোক আমাদের মহল্লার যাঁরা খিত্তার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের ছাড়া আমরা আমাদের মসজিদ থেকে আরও আটজন ইজতেমায় গিয়েছিলাম।
এরপর আরও কিছু লোক আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর আমাদের জামাতটা হলো সতেরোজনের। ফজরের নামাজের পর বয়ান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর অন্য সব জামাতের মতো আমরাও পরামর্শে বসলাম। তাবলিগ জামাতে পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আগামী এক দিন জামাতের কে কী দায়িত্ব পালন করবেন তারই সিদ্ধান্ত হয় পরামর্শে।
প্রত্যেকে তাঁর মতামত পেশ করেন। আর আমির সাহেব সিদ্ধান্ত দেন। সবাই এ সিদ্ধান্ত বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেন। যাহোক সেদিন সিদ্ধান্ত হলো, আমরা প্রত্যেকেই দুই শ টাকা করে বাইতুল মালে জমা দেব। যাঁরা খেদমতে থাকবেন, তাঁরা এ টাকা জামাতের যাবতীয় কাজে ব্যয় করবেন। প্রথম দিন পাঁচজনের ওপর খেতমতের দায়িত্ব পড়ল। এর মধ্যে আমিও একজন। এক দিনের বাজার করা, রান্নাবান্না করা আর পরিবেশন করে জামাতের সদস্যদের খাওয়ানো সব দায়িত্ব আমাদের।
যাহোক আমরা চারজন বাজারে গেলাম। সেদিন শুক্রবার থাকায় রান্নাবান্না একটু আগেই শেষ করতে হবে, তাই একটু সকাল সকাল বাজারে গেলাম। টঙ্গীর বাজারে সেদিন ছিল উপচে পড়া ভিড়। দুজনকে তরকারি ও অন্যান্য জিনিস কিনতে পাঠালাম। আর দুজন গেলাম গরুর গোশতের দোকানে। গোশতের দোকানে লাইনে দাঁড়ানোর অবস্থা। প্রতি কেজি গোশতের দাম সাত শ টাকা। দামাদামি করার সুযোগ নেই। তরকারির দোকানেও প্রচুর ভিড়।
যাহোক জিনিসপত্র কিনে এগুলো নিয়ে ভিড় ঠেলে আবার ময়দানে ফেরা। এরপর রান্নার পালা। আমি অবশ্য তেমন রান্না করতে পারি না। অন্যরা রান্না করেছেন। আমি শুধু কোটা–বাছায় সাহায্য করেছি। তাবলিগ করেন এমন কিছু লোক আছেন, যাঁরা নারীদের চেয়েও ভালো রান্না করতে পারেন। এ ছাড়া তাবলিগে গেলে খাবার স্বাদও লাগে অনেক বেশি। আলুভর্তা, ডাল বা তরকারি যা-ই হোক না কেন, সব কিছু খেতে অসাধারণ লাগে। যাহোক জুমার নামাজের আগেই আমাদের রান্না শেষ হয়ে যায়। রান্না করার সময় তরকারির যে গন্ধ বেরোয়, তাতেই বুঝেছিলাম যে খাওয়াটা জমজমাট হবে। আর বাস্তবে হয়েছিলও তা–ই।
২০ জানুয়ারি শুক্রবারের জুমার নামাজের জামাতটা ছিল বিশাল বড়। ইজতেমার ময়দানে আমরা কয়েক লাখ লোক তো ছিলামই। এর সঙ্গে বাইরে থেকে আরও অসংখ্য মানুষ জুমার নামাজ পড়তে আসেন। ফলে জামাত এত বড় হয়, যা বলে বুঝানো যাবে না।
আর যিনি ইমামতি করেন, তিনি এমন শান্তশিষ্ট ও ধীরস্থিরভাবে এবং রুকু সিজদায় বেশ সময় নিয়ে এমন সুন্দরভাবে নামাজটা পড়িয়েছেন যে মনটা একেবারে ভরে যায়। নামাজ পড়ে এমন তৃপ্তি পেয়েছি যে মনে হয়েছে, এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা নামাজ। ২০০৫ সালে হজের সময়ও কাবা শরিফ ও মসজিদে নববিতে নামাজ পড়েও খুব তৃপ্তি পেতাম। বহুদিন পর ইজতেমায় জুমার নামাজটা পড়েও তেমন মানসিক প্রশান্তি পেলাম।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর বয়ান শুনলাম। বয়ানের পর খাওয়াদাওয়া সেরে একটু ঘুমালাম। ঘুম থেকে ওঠার পর আসরের আজানের সময় হলো। সঙ্গে সঙ্গেই টয়লেট বিল্ডিংয়ের দিকে দ্রুত গেলাম। বিল্ডিংয়ের সঙ্গেই ওজুখানা। ভাবলাম, জরুরত সেরে ওজু করে আসরের নামাজ পড়ব। কিন্তু টয়লেট বিল্ডিংয়ের কাছে পৌঁছার আগেই এমন একটা ভিড়ের মধ্যে পড়লাম যা কল্পনাও করতে পারিনি। লাখো মানুষের আসরের নামাজের জন্য প্রস্তুত হওয়ার তাড়া। সবাই জামাতে নামাজ পড়তে উন্মুখ। ফলে যা হওয়ার তা–ই। মানুষ না পারছিল এস্তেঞ্জা করতে, না পারছিল ওজু করতে। মহাঝামেলায় পড়লাম। জামাতে নামাজ না পাওয়ার আশঙ্কায় পড়ে গেলাম। টয়লেটের সিরিয়ালে দাঁড়ালাম।
টয়লেটে ছোট এস্তেঞ্জা সারতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। এরপর ওজুর জন্য সিরিয়াল। ভাগ্যিস আমি আগেই বদনা কিনেছিলাম। আমার আগে ওজুর সিরিয়ালে থাকা একজনকে পানি দিতে অনুরোধ করলাম। ভদ্রলোক আমার বদনায় পানি দিলেন। আমি কোনো রকমে ওজুর ফরজগুলো আদায় করলাম। ইতিমধ্যেই নামাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি একরকম দৌড়ে গিয়ে নিকটস্থ জায়গার একটা কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজে শরিক হলাম।
সে যাত্রায় জামাত হারানো থেকে বেঁচে গিয়ে খুব ভালো লাগল। কিন্তু আমি লক্ষ৵ করলাম, এস্তেঞ্জা ও ওজু সেরে অনেকেই নামাজের জামাতে শরিক হতে পারেননি। তাঁদের অবশ্য আন্তরিকতায় কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাঁদের জন্য জামাতে শরিক হওয়ার সুযোগ ছিল না। মহান আল্লাহ তায়ালা অবশ্য নিজ গুণে তাঁদের দয়া করে জামাতের সওয়াব দিয়ে দিতেও পারেন। পরের দিন শনিবারের ফজরের নামাজের আগে এস্তেঞ্জা ও ওজুর ক্ষেত্রে ভিড় আরও বেশি হয়। আমরা টয়লেট ব্যবহার করতে তিনতলায় উঠছিলাম।
অনেক কষ্ট করে এস্তেঞ্জা সেরে নিচে নামার জন্য সিঁড়ির কাছে এসে দেখি, মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। এ ভিড়ের কারণে কেউ না পারছে নিচে নামতে আর কেউ না পারছে ওপরে উঠতে। আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। যাহোক অনেকক্ষণ আমরা আটকে থাকার পর নিচে নামার একটু সুযোগ হলো। চলবে...