১২ দিনে দেখা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, দুর্যোগেও জীবনের হাতছানি!-২
৭.
তাই সিদ্ধান্ত হলো, এদের সবাইকে এখনই ঢাকায় পাঠানো হবে। টিমে জনবল যা আছে তা আপাতত যথেষ্ট। তবে অপারেশনের জন্য আমাদের অতিরিক্ত স্পিডবোট প্রয়োজন, ইঞ্জিন নৌকা হলেও চলবে অবশ্য। এই দুই কাজের দায়িত্ব নিতে রাজ ভাই আমাকে অনুরোধ করলেন। তিনি আমার হাতে গুঁজে দিলেন হাজার বিশেক টাকা। রুমাল দিয়ে পেঁচিয়ে খুব যত্ন করে টাকাগুলো ব্যাগের এক কোণে রাখলাম। পাবলিক ডোনেশনের টাকা এগুলো, এর এক পয়সাও এদিক-ওদিক হলে এর গ্লানি আজীবন তাড়া করবে।
এরপর ওদের নিয়ে লালপুল ব্রিজ থেকে মহিপাল মোড়ের দিকে যাত্রা শুরু। রাস্তায় রিকশা, সিএনজি কিছুই নেই। দুই পা–ই ভরসা। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নির্ঘুম রাত শেষে মধ্যপ্রহরে এই ক্লান্ত প্রাণ নিয়ে যখন এগোচ্ছিলাম, দেখলাম দুদিকে শুধুই পানি। মাঝ বরাবর হারিয়ে যাওয়া শিশু, নর–নারীর কান্না, গবাদিপশু আর মানুষের ক্ষুধার্থ মুখ—সব সরল রেখায়। সড়ক বিভাজকের ওপরেই কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা বসে প্রহর গুনছে এই প্রক্ষীপ্ত সময়ের। সেদিন মানবজমিনের বুক থেকে জাত-পাত, পরিচয় আর অহংকারের বিভাজন রেখা ডুবে গিয়েছিল বন্যার পানিতে। অনেকটা হাশরের ময়দানের মতো অবস্থা। এদিকে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা, মনে হচ্ছে অনেক পথের মতোই দীর্ঘ।
তবে সর্বনাশের আশপাশেই যে পৌষ মাস থাকে, তা–ও নজরে পড়ল। স্থানীয় কয়েকজনকে দেখলাম এ বন্যার পানিতেই জাল ফেলে মাছ ধরছে। আমাদের কাছে মাছ বেচার জন্য জোরাজুরি করছিল কয়েকজন, তা–ও মাছ আন্দাজ নগণ্য দামে। যেমন বড় বড় চিংড়ি মাছের কেজি ৭০ টাকা চায়, ৩০–৪০ বললেও দিয়ে দেয় পারলে। এ রকম মাছের দাম ঢাকার বাজারে অনায়াসে হাজার টাকার বেশি হবে। তবে কেনার মতো লোক নেই বলেই চলে। যেখানে শুকনা খাবার আর সুপেয় পানি পাওয়া সৌভাগ্য, সেখানে মাছ কিনতে চাইবে কেউ!
পাঁচ কিলোমিটারের সেই পথ শেষে অবশেষে মহিপাল মোড়ে এসে পৌঁছালাম বেলা একটায়। এদিকে পিপাসায় ক্যাকটাস অবস্থা প্রত্যেকের। একটু দূরেই দেখলাম বেশ কয়েকজন হাতে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে। পিপাসার্তদের পানি খাওয়াচ্ছে বিনা মূল্যে। দৌড়ে গেলাম। প্রত্যেকেই প্রায় আধা জগের মতো করে খেলাম। খর তাপে চৌচির মাঠে বৃষ্টির নামার মতো করেই গলা দিয়ে পানি নামছিল। চোখেমুখে ফুটে উঠল কৃতজ্ঞতাবোধের স্পষ্ট ছাপ। মন থেকে দোয়া করা কী জিনিস, তা পুনরায় আবিষ্কার করলাম আমি।
৮.
এবার পরের আলাপে আসা যাক। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এখান থেকে সরাসরি ঢাকাগামী কোনো গাড়ি পেলাম না। এখন উপায় একটাই, বাসে করে প্রথমে চৌমুহনী পৌঁছাতে হবে। সেখানে গেলে ঢাকার দিকে কোনো না কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে নিশ্চিত। তা–ই করলাম। পৌঁছে দেখি হাইওয়ের ওপরেই প্রায় দেড় ফুট পানি এবং উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। কারণ, এদিকটা নিচু, বন্যায় প্লাবিত এলাকার পানি এদিক দিয়ে পাস করে সাগরের দিকে যাচ্ছে। যাই হোক, সেখান থেকে সাতজন ছেলেকে আরেকটা ঢাকাগামী বাসে তুলে দিলাম। বাকি রইল হারাধনের চার পুত্র, আকিব, আবদুল্লাহ, শুভ আর আমি। যাক, আমাদের আজকের মিশনের প্রথম অংশ শেষ হলো তবে। অবশ্য ওরা নিরাপদে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত শেষ বলা যায় না।
এবার নৌকা খোঁজার পালা। বাসস্টেশনের পাশের চায়ের দোকানে দেখলাম মুরব্বি গোছের কয়েকজন পান–সিগারেট খাচ্ছে। বোঝা যায় স্থানীয় মানুষ এরা। এদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বললে একটা ঠিকানা দিল আমাদের। চৌমুহনী থেকে কয়েক কিলো দূরে সেই জায়গা। তা নামটা আমার খেয়াল নেই অবশ্য। তবে সেখানে গেলে নাকি নৌকা পাওয়া যাবে, আমরা যেমনটা খুঁজছি আরকি।
একটা সিএনজিচালিত নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। হাইওয়ের পাশেই বেশ কয়েকটা ছোট ছোট দোকানের মতো, ছাপড়ি দোকান বলা যায় আরকি। নৌকা বানিয়ে বিক্রি করে ওরা। তবে ততক্ষণে নৌকা প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেছে আর বাকিগুলো বুকড। আরও কয়েকটা দোকান খোঁজাখুঁজি করার পর অবশেষে পেলাম আমাদের উপযোগী নৌকা। ছোট নৌকা, তবে কাজ চলবে এতে। দাম চাইল অনেকটা সেই মাছ বিক্রেতার মতো, তবে উল্টোদিকে! কোরোসিন কাঠের ডিঙিনৌকা যার দাম সর্বোচ্চ ৪-৫ হাজার টাকা, তার দাম চাইছে ১৫ হাজার!
এতেও অসুবিধা ছিল না, যদি একটা ইঞ্জিন অন্তত থাকত। ইঞ্জিন থাকলে টাকা আরও বেশি দেব লাগে। ফান্ড থেকে রাজ ভাইয়ের দেওয়া টাকার অবশিষ্ট ১৫ হাজার ছাড়াও আমার কাছে বেশ কিছু ক্যাশ টাকা আছে, প্রয়োজনে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেও তোলা যাবে। তবে ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা নিয়ে ফেনীতে অপারেট করা অসম্ভব ব্যাপ্যার। পানিতে স্রোত তো আছেই, এ ছাড়া জায়গা বিশেষে ১২-১৪ ফিট গভীরতা। বৈঠা দিয়ে টানতে গেলে স্রোতে খেই হারিয়ে ফেলা কিংবা দুলুনিতে নৌকা উল্টে যাওয়া অসম্ভব কিছু না।
নৌকা বেপারীর কাছে সব খুলে বললাম। বেপারী আইডিয়া দিল আগে আলাদা করে ইঞ্জিনটা কিনে নিতে। ইঞ্জিন, প্রপেলার আর আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ এগুলো আনতে পারলে ও নৌকার সঙ্গে ফিট করে দিতে পারবে। সঙ্গে ঠিকানাও দিল একটা, ওখানে নাকি নৌকার সেকেন্ড হ্যান্ড ইঞ্জিন পাওয়া যায়। সেই সিএনজির মামাকে নিয়ে গেলাম ঠিকানা মোতাবেক। মেইন রোডের পাশেই একটা বাজারের মতো! গিয়ে দেখি সত্যিই ওখানে এক দোকানে এসব বিক্রি হয়। খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল আমাদের উপযোগী একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ইঞ্জিন। দামও খুব বেশি না, ৮ হাজার টাকা সঙ্গে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির খরচ ৪-৫ হাজার।
হায় কপাল! কিনতে যাব এ সময় দেখি ইঞ্জিন আছে, আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশও আছে, তবে ওদের কাছে প্রপেলারটা নেই। মুহূর্তেই বদলে গেল আমাদের মনোভাব। দিগ্বিদিকশূন্য লাগছিল, তবে ভাগ্যের এ পরিহাসে আমরা চারজনই ফিক করে হেসে ফেললাম একসঙ্গে।
এভাবে আর কত! আমরা কি তবে আরও কিছুদূর খুঁজব, নাকি এখানেই খোঁজাখুঁজির ইস্তফা দিয়ে ফিরে যাব ক্যাম্পে। তবে এত দূর এসে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে, এটা ভেবে খারাপ লাগছিল। নিজেরা এসব নিয়ে যখন কথা বলছিলাম, দোকানদার আমাদের আলাপ–আলোচনা মন দিয়ে শুনছিল। সব শুনে আরেক জায়গার ঠিকানা দিল ও। সেখানে নাকি মাছ ধরার নৌকা এসে ভেড়ে। খুঁজলে সাগরে চলা স্পিডবোট পাওয়া যেতে পারে। ওরা নাকি দৈনিক হিসাবে স্পিডবোট ভাড়া দেয় চুক্তিতে। সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানেই যাব। রওনা দিলান নোয়াখালীর উদ্দেশে।
৯.
লোকালয় থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে যখন উঠলাম, ততক্ষণে সন্ধ্যা। দুই লেনের সরু অন্ধকার সড়কে যানবাহন নজরে পড়ল অল্পই। আলোর উৎস নেই বললেই চলে, মাঝে মাঝে দূর থেকে জোনাকির আলোর মতো ছোট ছোট চায়ের দোকান দেখা যায় কেবল। ক্ষীণ আলো দূর থেকে কাছে আসে, এরপর মিলিয়ে যায় পেছনের অন্ধকারে। মফস্সল শহরের সঙ্গে সংযুক্ত সড়কগুলোর চিত্র যেমনটা হয় আরকি।
এদিকে ঘাড়ে, কপালে আর চুলে ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে ঘুম এসে যাচ্ছিল। শরীর খুব ক্লান্ত! আমার পাশে বসে আছে আকিব। চেহারায় স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ! ওর যে পরিস্থিতি, এতে কী বলে যে ওকে শান্ত করব, তা আমার জানা নেই। আকিবের গল্পটা একটু বলি এবার—
উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র, ছিপছিপে লম্বা। মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে লেখাপড়া করেছে। ঢাকায় মামার সঙ্গে মেসে থাকে। এদিকে ওর ছোট দুই ভাই-বোনকে নিয়ে ওদের মা সোনাগাজী উপজেলার ডাকবাংলো থেকে কিছুটা দূরে গ্রামে থাকেন। সোনাগাজী থেকে ফেনী শহরের দূরত্ব আনুমানিক ২০ কিলোমিটার। ওখানেই ওদের পৈতৃক ভিটা, তবে কর্মসূত্রে বাবা থাকেন ভিন্ন জেলায়। দুই দিন ধরে মা আর ছোট ভাই-বোনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তবে সর্বশেষ যখন কথা হয়েছিল, তখন ওদের উঠানে ৩-৪ ফিট পানি, জায়গাভেদে সে এলাকায় পানি ১২-১৪ ফিট ছাড়িয়েছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। টিনশেডের বাড়ি, তবে পাশেই ওদেরই দোতলা পাকা দালান নির্মাণাধীন, দ্বিতীয় তলার ছাদ কেবল ঢালাই হয়েছে, তাই খুব বেশি পানি উঠে গেলে আশ্রয় নিতে পারবে অন্তত। তবু পরিবারের খোঁজ না পাওয়া ভয়াবহ দুশ্চিন্তার। গতকাল রাতে যখন রওনা দিচ্ছিলাম, ওর মামা এসে আমাদের হাতে বুঝিয়ে দেয় ওকে। মূলত পরিবারের খোঁজ নিতেই ও আমাদের সঙ্গে এসেছে। গতকাল থেকেই ওর বাবা ওকে ঘন ঘন ফোন দিচ্ছিল, আমার সঙ্গেও কথা হলো কয়েকবার। আকিব আর ওর বাবাকে বারবার অভয় দিয়ে বললাম, আজকে স্পিডবোট অথবা ইঞ্জিনের নৌকা, যেকোনো একটা কিছু জোগাড় হলেই সবার আগে আমরা ওদের বাড়িতেই যাব। প্রয়োজনে রাতেই যাব। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা!
ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে পরিবার নিয়ে ব্যাপক দুশ্চিন্তায়। তবে কথা শুনে মনে হলো তিনি ঠান্ডা মাথার মানুষ।
আমাদের রাতের বেলায় যেতে নিষেধ করলেন! বললেন এতে বিপদ আছে। তাই আমরা যেন অন্তত ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এদিকে তখনো তাঁর স্ত্রী–সন্তানের খোঁজ নেই!
তবে রাতে পানিতে সেনাবাহিনী আর নৌবাহিনী থেকেও আমাদের এমনটাই বলেছে। পানির ভেতর কোনো কারণে বিপদে পড়লে অন্ধকারে হেলিকপ্টার দিয়ে লকেট করাও কঠিন ব্যাপার। তা ছাড়া ডাকাতির ভয় তো আছেই। চলবে...