১২ দিনে দেখা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, দুর্যোগেও জীবনের হাতছানি!-১
১.
সাপের কামড়, জীবন্ত প্রাণ ও নিথর দেহ, সঙ্গে ছিল খিদে ও বেঁচে থাকার আশা। টানা বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য রোদ উঁকি দিত ক্ষণিকের জন্য। তবে ঝলমলে আকাশের দেখা পেয়েছিলাম ঘটনার শেষাংশে। একসময় নেটওয়ার্কেরও বাইরে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা, আবার সেই নেটওয়ার্কের সাহায্যেই জীবন রক্ষার জন্য চালিয়েছি আপ্রাণ চেষ্টা। ফেনীতে কাটানো ১২ দিনের অভিজ্ঞতা ছিল রূঢ় বাস্তবতা ও রোমাঞ্চে ভরা। অনেকটা হেরি রাইডারের লেখা রোমাঞ্চকর উপন্যাসগুলোর মতোই। তবে আমার গল্পটা বাস্তব, তফাত এখানেই। এ সময় একেক দিনের অভিজ্ঞতা মনে হয়েছে একটা বই পড়ার সমান।
সময় আনুমানিক সকাল ১০টা। প্রতিদিনের মতোই নাশতার পর মুঠোফোন টিপছিলাম আর চা খাচ্ছিলাম। এমনিতে কিছুটা অলস প্রকৃতির আমি। অন্য কোনো কাজ না থাকলে পড়ালেখা শুরুর আগে ঘণ্টাখানেক এভাবেই কাটে। তা মুঠোফোনের স্ক্রিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সিয়াম ভাইয়ের স্ট্যাটাস চোখে পড়ল। বন্যাকবলিত ফেনীতে উদ্ধারকাজে মিরপুর থেকে টিম যাবে। স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন, আগ্রহী ব্যক্তিরা যেন যোগাযোগ করে। আগপাছ না ভেবে ভাইকে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে জানালাম আগ্রহের কথা। আদৌ যাব কি না, এ ব্যাপারে সে সময়ও নিশ্চিত ছিলাম না। কারণ, আমার স্বজন অথই আপুর বিয়ে দুই দিন পরই। পাঞ্জাবিও কিনেছি। বিয়েতে থাকব, না উদ্ধারের কাজে যাব, তা ভাবছিলাম। পরের দিন বাবার সঙ্গে আলোচনা করলাম। সবকিছু শুনে বন্যার্তদের উদ্ধারের কাজে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন। বলে রাখা ভালো, বাবার কথায় ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নিতে। সেদিনের সে গল্প নাহয় আরেক দিন লিখব।
বেশ কয়েকজনকে দেখলাম দুই হাতে বিস্কুট গোগ্রাসে গিলছে। ‘পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক’ সিনেমার কথা বাদ দিলে আমি সামনাসামনি কখনো কাউকে এভাবে খেতে দেখিনি এর আগে। শুনেছি, খুব ক্ষুধা পেলে নাকি মানুষ সভ্যতার শেখানো সমস্ত ব্যাকরণ ভুলে যায়।
২.
সিয়াম ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানলাম, প্রাথমিক পরিকল্পনার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে একটা মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে মিরপুর ২ ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা ৬০ জনের উদ্ধারকারী দল তিনটি ভাগে উদ্ধারকাজ চালাব। রেসকিউ টিম, মেডিকেল কোর ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। আমি রেসকিউ টিমের সঙ্গে কাজ করব। সরাসরি পানি থেকে বন্যার্তদের উদ্ধার করে নিয়ে আসবে এই দল। কারণ, আমি বরাবরই রোমাঞ্চ ভালোবাসি। রহস্য, রোমাঞ্চ ও ঝুঁকি কৈশোর থেকেই আকৃষ্ট করে। তবে ঘটনাক্রমে তিন দিন পরে মেডিকেল কোরের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। এ সময় আড়াই শ থেকে তিন শ মানুষের চিকিৎসাও করেছি। নানাবিধ রোগ তাদের। সাপে কাটা রোগী, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত, পচে যাওয়া ক্ষতস্থান, স্কিন ইনফেকশন, খাদ্যে বিষক্রিয়া থেকে শুরু করে প্যানিক অ্যাটাক, অ্যাজমাসহ আরও কত–কী নিয়ে যে কারবার করেছি সে সময়, তার হিসাব করাও কঠিন। তবে ঢাকা ফেরার আগে আমার যাত্রা ফেনীর মহিপাল থেকে সীতাকুণ্ড হয়ে কক্সবাজার গিয়ে থিতু হয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। সার্বিকভাবে এ অভিজ্ঞতা ছিল অপ্রত্যাশিত ঘটনায় পূর্ণ, যা মনের চোখ খুলে দেওয়ার মতো শক্তি রাখে। সে গল্পই আমি বলব আজ...
৩.
আমাদের যাত্রা শুরু হলো মিরপুর ২ ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে থেকে রাত ১১টায়। ফেনী পৌঁছানোর জন্য জোগাড় করা হলো রংচটা জীর্ণশীর্ণ লোকাল বাস। মুড়ির টিন বলা যায় আরকি। আমার দৃষ্টিতে এগুলো গরিবের রোলার কোস্টার। এতে চড়লে কাছাকাছি অনুভূতি পাওয়া যায় আরকি। তবে রোলার কোস্টারের সিট থেকে বাসি পনিরের মতো এমন গন্ধ আসে কি না জানা নেই। সে যা–ই হোক, সবই সই এখন। আপাতত ফেনী যাওয়াটাই মুখ্য। তবে বাসের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যাত্রীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া বাসভর্তি পণ্য, মেডিকেলের কার্টন ও অন্য সামগ্রী। উদ্ধারকারী দলের ২০ জনের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল যাত্রার শেষ অবধি। অবশ্য পালাক্রমে আমরা তাদের বসতে দিয়েছি, তখন আমরা দাঁড়িয়েছি। যে পরিস্থিতি, এতে দম নেওয়াও কঠিন ব্যাপার। তবে উদ্যম ছিল অদম্য। তাই কোনো কিছুই খুব একটা অসুবিধা মনে হচ্ছিল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্য শাহবাগে গিয়ে দেখলাম, আনসার সদস্যরা আন্দোলন করছে। কোনো গাড়ি যেতে দিচ্ছে না। আমরা উদ্ধারকারী দল, তা জানার পর আর আটকাল না। দোয়েল চত্বর হয়ে বাস গিয়ে থামল অমর একুশে হলের সামনে, আনুমানিক রাত ১২টা ৩০। সেখানে সাময়িক বিরতি। কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেলে সারসিজ ভাই সঙ্গে আরও কয়েকজন এল দেখা করতে। শাওন ভাই, রাজ ভাই আর সারজিস ভাইদের ভেতরে আলোচনা চলল কিছুক্ষণ। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো মিরপুর রেসকিউ টিমের সঙ্গে অমর একুশে হল যৌথভাবে উদ্ধারকাজে অংশ নেবে। ইতিমধ্যে জোগাড় হলো দুটি ইঞ্জিন নৌকা, দুটি পিকআপ ট্রাকের পেছনে আলাদাভাবে রাখা। খুব সম্ভবত সদরঘাটের নৌকা এগুলো। হল থেকে দেওয়া রিলিফসামগ্রী দিয়ে নৌকা পূর্ণ হলে অবশেষে ফেনীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো দিবাগত রাত দুইটার দিকে।
৪.
ফেনীর শহরের অদূরে মহিপাল মোড়ে পৌঁছালাম সকাল আটটার দিকে। মহিপাল মোড় পার হতেই দেখলাম রাস্তার দুই ধারে সবকিছু পানির নিচে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে চট্টগ্রাম অভিমুখে কিছুটা এগোলেই লালপুল সেতু। বাস এখানে থামল। কারণ, এরপর কিছুদূর এগোলে রাস্তাও পানির নিচে। তাই সেখানেই সড়কের মাঝবরাবর চওড়া সড়ক বিভাজকের ওপর কিছু রিলিফের পণ্য আর মেডিকেলসামগ্রী নামিয়ে রাখতে শুরু করলাম। আপাতত এটিই আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। এদিকে দুটি ট্রাক রিলিফভর্তি নৌকাসহ এগিয়ে গেল সামনে দিকে।
তখনো বোধ হয় আধা ঘণ্টাও হয়নি। আমাদের রেসকিউ টিমের কয়েকজন সদস্য লক্ষ করল, কেউ একজন পানিতে সাঁতার কেটে লালপুল সেতুর দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা সে সময় সেতুর ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে রাস্তার দুদিকের জমির উচ্চতা ভিন্ন হওয়ায় ব্রিজের নিচ দিয়ে তীব্র স্রোতে পানি এক দিক থেকে আরেক দিক দিয়ে ধেয়ে আসছে। সাঁতার কাটা ব্যক্তির অবস্থান উজানের দিকে। তবে পানির এ তীব্র স্রোত কেবল ব্রিজের আশপাশের এলাকায়, উজানের দিকে কিছুটা দূরেই পানি তুলনামূলক শান্ত। তাই দূর থেকে, বিশেষ করে সাঁতার কাটা সেই ব্যক্তির দৃষ্টিসীমায় তা নজরে পড়ার কথা নয়, তবু স্বেচ্ছাসেবকেরা হাতের ইশারায় ব্রিজ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত করলেও সে দ্রুত সাঁতরে ব্রিজ বরাবরই এগিয়ে আসে। একপর্যায়ে স্রোতের পরিসীমার কাছাকাছি চলে এলে দ্রুতগতিতে স্রোতের টানে এগিয়ে যায় সেই ব্যক্তি আর সজোরে বাড়ি খায় ভায়াডাক্টের সঙ্গে। পানি সাধারণত ব্রিজের ভায়াডাক্ট থেকে অন্তত কয়েক ফুট নিচ দিয়ে অতিবাহিত হয়। তবে বর্তমানে পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে তা সরাসরি ভায়াডাক্টের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছিল। উচ্চতা আর এক ফুট বেড়ে গেলে ব্রিজও ডুবে যাবে। বাড়ি খেয়ে তীব্র স্রোতের টানে ব্রিজের তলা দিয়ে বেরিয়ে এল সে। আর বেশি কিছু না ভেবে হাতে লম্বা রশির গোছা নিয়ে তত্ক্ষণাৎ ভাটির দিকে নেমে পড়ল উদ্ধাকারী দল। যদিও তারা লাইফজ্যাকেট পরা ছিল, তবু এভাবে পানিতে নামাটা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এমন স্রোতে উদ্ধাকারীর ভেসে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
৫.
যা–ই হোক, উদ্ধারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বয়সে তরুণ, ২০ থেকে ২২ বছর বয়স হবে। পানি থেকে তুলে নিয়ে আসা হলো সড়ক বিভাজকের ওপর, অর্থাৎ যেখানে আমরা সাময়িকভাবে ক্যাম্প করেছি। একমুহূর্তও দেরি না করে মেডিকেল টিম কাজ শুরু করে দিলে আমিও যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। চেক করে দেখলাম, পালস রেট ও ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। এদিকে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল কমে গেছে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। এমন ধকলের পর অবশ্য এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ছেলেটা অন্তত নিশ্বাস নিতে পারছে। তাই গুরুতর জখম না হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালস রেট ও অন্য প্যারামিটারগুলো স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে ফুসফুসে যে পানি ঢুকেছে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ফুসফুসের পানি বের করার মতো কোনো যন্ত্রপাতি সে সময় আমাদের কাছে ছিল না। সে ক্ষেত্রে উল্টো করে শুইয়ে, মাথা নিচে আর পা ওপরে রেখে প্যারামেডিকেল পদ্ধতির প্রয়োগ করা যেতে পারে। তা করা গেল না; কারণ, ছেলেটা অত্যন্ত দুর্বল, ///সেই সঙ্গে ভীত। মাটির ওপরেই শুয়ে ক্ষীণভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছিল, এদিকে দুজন স্বেচ্ছাসেবক একনাগাড়ে তার হাত-পায়ের তালু ঘষছে। মিনিট বিশেক পর খেয়াল করলাম হাত ও পায়ের পাতা একটু একটু করে নড়তে শুরু করল। আঙুল নড়াতে বললে দুই হাত আর দুই পায়ের আঙুল নাড়িয়ে দেখাল। ছেলেটা শুরুতে ভায়াডাক্টের সঙ্গে কপাল বরাবর বাড়ি খেলেও মাথা ফাটেনি অন্তত। যদিও পানির স্রোতের সঙ্গে ব্রিজের তলা দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময় মেরুদণ্ড অথবা অন্য কোনো হাড়ে গুরুতর আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা আছে। তবে ভালো খবর এই যে হাত-পায়ের আঙুল নড়াতে পারার অর্থ কোনো হাড় ভাঙেনি অন্তত। তাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা, আপাতত সে শঙ্কামুক্ত। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলে জানতে চাইলাম, ঠিক কী কারণে পানিতে সাঁতার কাটছিল? আর ব্রিজের দিকেই–বা এগোল কেন? স্থানীয় ভাষায় যা বলল, তা থেকে এটুকু বুঝলাম—ও যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকে বেশ কিছুটা দূরে একটা ছয়তলা ভবনে কয়েক শ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় মানুষ সবাই। তাদের ঘরবাড়ি সব পানির নিচে। তা সে আশ্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট। তৃষ্ণায় অনেকে বন্যার পানি খাচ্ছে। তখন পর্যন্ত ত্রাণ নিয়ে কোনো উদ্ধারকারী নৌকা যায়নি সেখানে। এমন পরিস্থিতিতে তারা কয়েকজন যুবক খাবার-পানির খোঁজেই পানিতে নামার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনামাফিক প্লাস্টিকের বোতল আর রাবারের টিউব দিয়ে তারা ভেলাজাতীয় কিছু একটা বানায়। সেই ভেলা ধরে সাঁতরে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছিল। ঘণ্টা দুয়েক সাঁতার কাটার পর ছেলেটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এরপর কোনো এক ফাঁকে স্রোতের টানে সে দলছুট হয়ে যায়। তবে সোজা কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছিল লালপুল সেতু। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আর আগপাছ না ভেবে সোজা সেতুর দিকে এগোতে থাকে। তাই আমাদের দেখানো সংকেত খেয়াল করেনি। এমন পরিস্থিতিতে অবশ্য হুঁশজ্ঞান কাজ করার কথাও নয়। এর পরের ইতিহাস তো জানাই।
এই কথোপকথনের ভেতরেই তার দলের অন্যরা সড়ক বিভাজকের ওপর আমাদের সেই অস্থায়ী ক্যাম্পে এসে হাজির হয়। বুঝলাম, তারা সবাই খুব ক্ষুধার্ত। আমাদের কাছে কয়েক বস্তা টোস্ট বিস্কুট আর পানি ছিল, রিলিফের চালান অধিকাংশ নৌকার সঙ্গে চলে গেলেও এটুকু আমরা রেখে দিয়েছিলাম। সেই খাবারই তাদের দিলাম খেতে।
৬.
এই সময় আশপাশ থেকে আরও অনেকেই খাবার চাইলে তাদেরও দিলাম। বেশ কয়েকজনকে দেখলাম দুই হাতে বিস্কুট গোগ্রাসে গিলছে। ‘পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক’ সিনেমার কথা বাদ দিলে আমি সামনাসামনি কখনো কাউকে এভাবে খেতে দেখিনি এর আগে। তবে শুনেছি—খুব ক্ষুধা পেলে নাকি মানুষ সভ্যতার শেখানো সমস্ত ব্যাকরণ ভুলে যায়। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার মতো করেই তার আদিম সত্তা জেগে ওঠে তখন। ক্ষুধার চেয়ে আদিম আর কীই–বা আছে! আমি অবাক বিস্ময়ে তাদের খাওয়া দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, ‘তবে খাওয়াও কি কোনো শিল্পকর্ম?’ যদি শিল্পই হয়, তবে যা দেখছি, তা খুব সম্ভবত আদিমতম আর্ট।
খাওয়াদাওয়া মোটামুটি শেষ হলে ছেলেটাকে তার দলের বাকি সদস্যদের হাতে বুঝিয়ে দিলাম। সঙ্গে দিলাম বেশ খানিকটা শুকনা খাবার আর কয়েক কেস পানির বোতল। এগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারবে তারা। ইতিমধ্যেই আরও কয়েকটা রেসকিউ টিম এসে হাজির হয়েছে। তারাও খাবারদাবার দিল তাদের। তবে দুঃখজনকভাবে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনো নৌযান আমাদের কারও কাছেই নেই। স্পিডবোট, ইঞ্জিনচালিত নৌকা—সব তখন অপারেশনে।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সেখানে লক্ষ করলাম আরেক বৃদ্ধ নারীর উপস্থিতি! বয়স ৭০–এর কাছাকাছি, জুবজুবে ভেজা জীর্ণশীর্ণ দেহ। যা বললেন, তাতে বুঝলাম—গলাসমান পানির ভেতর দিয়ে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে মহাসড়কে উঠেছেন, এরপর এগোতে এগোতে এসে পৌঁছেছেন এখানে। এখন তীব্র শ্বাসকষ্টে ঠিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছেন না। তাই মুখে স্যালবুটামল ট্যাবলেট দেওয়া হলো। তবে বৃদ্ধাকে ইমারজেন্সি নেবুলাইজার দেওয়া প্রয়োজন।
এদিকে যন্ত্রপাতি সব বাক্সবন্দী। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি—তীব্র শ্বাসকষ্ট অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হয় মহাকালের মতো দীর্ঘ। তাই আর কালক্ষেপণ না করে বাক্সের ভেতর থেকে মোটামুটি যন্ত্রের বেগেই নেবুলাইজার মেশিনটা হাতড়ে বের করলাম। বাদ সাধল ভিন্নখানে!
নেবুলাইজার মেশিন চালানোর জন্য ২২০ ভোল্ট বা ৪০ ওয়াটের বিদ্যুৎ–সংযোগ প্রয়োজন। আশপাশে বিদ্যুতের লাইন কোথায় পাব? আমাদের কাছে তো জেনারেটরও নেই।
চট করে মাথায় এল—আমরা তো চাইলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো একটা ট্রাক থেকেও বিদ্যুৎ নিতে পারি। সেই চেষ্টা অবশ্য করলাম, তবে লাভ হলো না। ট্রাকের ব্যাটারি থেকে বিদ্যুৎ টেনে নেওয়ার মতো কোনো উপযুক্ত তার বা কনভার্টার আমাদের ছিল না। বিদ্যুতের লাইন বা সংযোগের বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে গিয়েও কিছু মিলল না। বৃদ্ধার শ্বাসকষ্ট তখন ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল, এ সময় খবর পেলাম, মহিপাল মোড়ে কোনো এক ভবনে আমাদের ক্যাম্প বসানো হচ্ছে। বাকি দিনগুলো আমরা সেখান থেকেই অপারেট করব। তৎক্ষণাৎ আমাদের মেডিকেল কোরের ডাক্তার তমা সেই বৃদ্ধাকে নিয়ে একটা ভ্যানে করে রওনা দিল মহিপালের উদ্দেশে। সঙ্গে দিলাম কিছু ওষুধপথ্য আর নেবুলাইজার মেশিনটা।
পরপর এমন সব ঘটনায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম খুব। বুক ধড়ফড় করছে। তাই সড়ক বিভাজকের কোনায় বসে বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। বারবার পানি খাচ্ছি, তবু একটু পরপর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ সময় খেয়াল করলাম, পাশেই বসে থাকা রেসকিউ টিমের তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বমি করে দিল। খেয়াল করলাম, ওর হাঁটুর নিচে অনেক বড় একটা আঘাত। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। কথোপকথন থেকে জানলাম ট্রাক থেকে নৌকা পানিতে নামানোর সময় দুর্ঘটনাবশত আঘাত লেগেছে পায়ে। এর পর থেকেই এখানে বসে আছে ও। নির্ঘুম রাত, শারীরিক আঘাত, এরপর আশপাশের দৃশ্য দেখে এখন আর নিতে পারছে ও। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া এক তরুণের পক্ষে এমন ধকল নিতে পারার কথাও নয়। এদিকে ওর বয়সী আরও বেশ কয়েকজন শুনলাম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চলবে...
**আগামীকাল পড়ুন: ১২ দিনে দেখা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, দুর্যোগেও জীবনের হাতছানি!–২