দীর্ঘদিনের শিক্ষার্থী-সংগ্রাম বনাম প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অবস্থানছবি: সাজিদ হোসেন

সালটি ছিল ২০০৯ এ, বছরের সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার কণ্ঠ তুলছিলেন। জানুয়ারি মাসের ২৭তম দিনে এই কণ্ঠ যখন সড়কে সড়কে পৌঁছাল, সেদিন যেন এক কালো অধ্যায়ের সাক্ষী হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ‘হল চাই, হল চাই’ স্লোগানে যখন রাজপথ প্রকম্পিত হচ্ছিল, তখনি ওপর পাশ থেকে ভেসে এল বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের মতো বিপর্যয়ের শব্দগুলো। পুলিশের টিয়ারশেলে গা পুড়িয়ে, আর ক্রমাগত রাবার বুলেটের নিক্ষেপে আহত হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। শুধু পুলিশি লাঠিচার্জ নয় বরং পুলিশি মামলার ভারও সইতে হয়েছে সেসব শিক্ষার্থীদের। এ ঘটনায় কার্যত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো পুরান ঢাকা অচল হয়ে পড়ে। পুরান ঢাকাসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ ২৯ দিনব্যাপী পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘রক্ত নে, হল দে’ স্লোগানে মুখরিত ছিল। বেশ কয়েকটি কমিটি গঠনপূর্বক সমস্যার সমাধান ও দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে প্রশাসন গা বাঁচিয়ে নেয়। তবে নামমাত্র এই পদক্ষেপের কোনো ইতিবাচক ফলাফলই শিক্ষার্থীদের হাতে এখনো মেলেনি। তবু অগ্রজদের সেই আত্মত্যাগ ও অবদানকে প্রতিবছর সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয় ২৭ জানুয়ারিকে ‘হল দিবস’ হিসেবে পালনের মাধ্যমে।

সমস্যায় জর্জরিত এই ব্যবস্থাপনাকে নিয়েই বেশ কয়েক বছর অতিক্রম করার পর পুনরায় ২০১৪ ও ২০১৬ সালে বড় দুটি হল আন্দোলন করে নিজের অধিকার নিয়ে রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ এ আবার শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দেওয়া হয় নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে ছাত্র হলের জন্য কার্যক্রম শুরু হতে চলেছে। তবে এ কার্যক্রমে কর্তৃপক্ষের গড়িমসি ও উদাসীনতার কারণে আজও ছাত্রদের জন্য সম্পূর্ণ অনাবাসিক রয়ে গেছে ক্যাম্পাসটি। ২০১৩ সালে ঘোষণা দেওয়া ছাত্রী হলের কার্যক্রমও নানা টালবাহানায় বারংবার পিছিয়ে অবশেষে ৬ বছর পর হলটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়, যদিও তা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা অনুযায়ী অপ্রতুল। তা ছাড়া প্রায় তিন দশক ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি হল প্রভাবশালীদের দখলে রয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালালেও আইনি জটিলতা ও স্থানীয়দের দ্বন্দ্বের মুখে হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। অপর্যাপ্ত বাজেট, আবাসন সংকট, ক্যাম্পাসের জায়গার সংকীর্ণতায় অপর্যাপ্ত ভবন ও ক্লাসরুমের সংকটে শিক্ষাবর্ষে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়াসহ শিক্ষাজীবনে অসংখ্য ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যর্থতায় আজ চরম ক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দূর–দূরান্ত থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা যখন কোনো রকম রাষ্ট্রীয় সহায়তা না পেয়ে নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য প্রতিনিয়ত টিয়ারশেলে গা পুড়িয়ে ও লাঠিচার্জে রক্তাক্ত হয়, তখন তা শুধু কর্তৃপক্ষের নয় বরং পুরো রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হতে ইউজিসি, ইউজিসি হতে মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয় হতে যমুনা এই দীর্ঘতম পথ যেন অনেকের নিকট অযৌক্তিক হয়ে উঠছে অথচ দীর্ঘ ১৬ বছরের ছাত্রছাত্রীদের রক্ত দিয়েও প্রাপ্য অধিকার ফিরে না পাওয়া আর আশ্বাস দিয়েই প্রশাসনের খালাস পেয়ে যাওয়া কারও নিকট ন্যায়বিরুদ্ধ মনে হয়নি।

প্রশাসনের এই রুদ্ধতাকে কেউ হয়তো প্রশ্নবিদ্ধই করবে না; কারণ, ‘রাষ্ট্র বোতলের হিসাব রাখে, বুলেটের হিসাব রাখে না।’ জুলাই বিপ্লবের নতুন সূর্যদোয়ের সূচনা যেখানে ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নিয়েই, সেখানে ২০২৫–এ এসেও সব ন্যায্য দাবির মুখে অমানবিক প্রতিক্রিয়া ও নীরব দর্শকের মতো প্রশাসনের ভূমিকা শুধুর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নয় বরং বিপ্লবের পর ফিরে পাওয়া নতুন রাষ্ট্রের জন্যই এক কলঙ্কিত অধ্যায়। বরাবরের মতো এ সোচ্চার ও সদা জাগ্রত কণ্ঠ এবারো হয়তো দমন করার প্রয়াস করা হবে, তবু তারা অন্তত বলতে পারবে, এমন কোনো কড়া ছিল না, যা তাঁরা নাড়ায়নি, এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে তাঁরা যাননি। রাষ্ট্রের জুলাই আন্দোলন হোক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল আন্দোলন-বিপ্লবের সব প্রান্তরে নির্ভীক জবিয়ানদের ইতিহাসে স্মরণ রাখা হবে।

*লেখক: সামিহা তাসনিম, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আরও পড়ুন