জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুর্দশা ও রাষ্ট্রের দায়

দাবি আদায়ে অনড় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থান। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় রাজধানীর কাকরাইল মোড়েছবি: প্রথম আলো

একই শহরে কেউ পান করে ওয়াসার ঠান্ডা পানি, আর কেউ কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া—রাষ্ট্র আসলে কার?

পুরান ঢাকার বুকের ভেতর গুমরে ওঠা দীর্ঘশ্বাসের নাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। দুই দশক ধরে আবাসনহীন এক বিশ্ববিদ্যালয়, যার শিক্ষার্থীরা ভাড়া বাড়ির ভাড়ায়, অনিশ্চয়তায় আর রাষ্ট্রের অবহেলায় প্রতিনিয়ত জর্জরিত। তাঁরা হাঁটতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে। দাবি ছিল মাথা গোঁজার ঠাঁই, শিক্ষার জন্য সংরক্ষিত ন্যায্য বাজেট আর স্বপ্নের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। কিন্তু রাষ্ট্র তাঁদের দিকে বাড়িয়ে দিল লাঠি, ছুড়ে দিল কাঁদানে গ্যাস, ঝাঁকে ঝাঁকে সাউন্ড গ্রেনেড। যেন তাঁরা কোনো ভিনদেশি দস্যু, যেন তাঁরা এ দেশের নাগরিকই নন।

গতকাল বুধবার দুপুরে ‘জুলাই ঐক্য’ নামে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমন্বয়ে গঠিত একটি প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে যাত্রা শুরু হয় ‘লংমার্চ টু যমুনা’। একাত্তরের গণহত্যা ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে শুরু হয় যাত্রা। সে যাত্রা ছিল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে, অবহেলার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক প্রতীকী অভিমুখ।

তিন দফা দাবি নিয়ে এই লংমার্চ

১. আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর করতে হবে।
২. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করতে হবে।
৩. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিন্তু রাষ্ট্র যেন কানে তুলা গুঁজে রেখেছে। কাকরাইল মসজিদের মোড়ে পৌঁছাতেই পুলিশ ব্যারিকেড তোলে। শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। কী নির্মম! যে শিক্ষকের হাতে লেখা থাকে শিক্ষাদানের আশীর্বাদ, ওই হাতেই লাগে লাঠির আঘাত। সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে না শুধু বিক্ষোভ, ধরা পড়ে রাষ্ট্রের নির্লজ্জতা।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান—সব যেন প্রস্তুতই ছিল। আহত হন অন্তত ১১ জন, তাঁদের মধ্যে শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেলে তাঁর দুর্ভাগ্য যেন মাত্রা ছাড়ায়!

অন্যদিকে মাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকার রাজপথে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আয়োজনে চলে ‘যমুনা অভিমুখে লংমার্চ’। সেখানে দেখা গেল শীতল পানির ছিটা, ওয়াসার খাওয়ার পানি, সুব্যবস্থাপনা আর বুফে খাবারের আয়োজনে সজ্জিত গণতন্ত্রের নাট্যমঞ্চ। রাষ্ট্র সেখানে বদান্য, দারুণ অতিথিপরায়ণ। পক্ষান্তরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যখন মিছিল করেন, তখন রাজপথে নেমে আসে গর্জন। রাষ্ট্র তখন ভয় পায়। কারণ, তারা জানে, দাবি যখন ন্যায্য, তা দমন না করলে দাবানলে রূপ নিতে পারে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানেন, অধিকারের জন্য গলার স্বর বাড়াতে হয়। বরাবর ‘এলিটিজম’-এর পক্ষাবলম্বনকারী এই রাষ্ট্র কি প্রতিবাদমুখর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো এক পরিকল্পিত অবহেলার যজ্ঞে ঠেলে দিয়েছে? নাকি এটি হচ্ছে এক নিষ্ঠুর সামাজিক প্রকৌশলের ফল, যেখানে কিছু প্রতিষ্ঠানকে কেবল পাঠশালা বানিয়ে রাখা হয়, যেন তারা কেবল স্বপ্ন দেখবে, বাস্তবায়ন কল্পনা কস্মিনকালেও না করে?

আজকের রাজপথ বলছে‌, এই রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক। কেউ রাজপথে হেঁটে আসে জলের ছায়ায়, আর কেউ ধোঁয়ায় দম বন্ধ করে পড়ে থাকে ফুটপাথে। আজ লাঠিপেটা হয়েছে, কাল হতে পারে আরও ভয়ানক কিছু। কিন্তু ইতিহাস বলে, নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও যারা হাঁটে, তারাই পথ তৈরি করে।