নিখোঁজ ডায়েরি
মির্জাপুর এলাকাটি মফস্সল না হলেও পুরোপুরি অজপাড়াগাঁ বলা যায় না। রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বাজারসহ বেশ কিছু উন্নয়নের চিত্র চোখে পড়ার মতো। কিশোরগঞ্জ জেলায় অনেক হাওর এলাকা থাকলেও এ এলাকাটি বেশ শুষ্ক। বর্ষাকালে যত বৃষ্টিই হোক, আর বাংলাদেশের কোথাও বন্যা হোক, তাতেও এখানকার নদী পুরোপুরি জলে ভরে না। এই এলাকায় কোনো কলেজ নেই, হাইস্কুল পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। নিকটবর্তী যে কলেজ, সেটাও কয়েক কিলোমিটার দূরে পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
সেই কলেজ থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে মির্জাপুর বাজার পর্যন্ত এসে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে অরণ্য। বর্ষাকাল চলছে, রাস্তায় জল জমে থাকা ও কাদা থাকা সাধারণ চিত্র। এ সময় কখন বৃষ্টি শুরু হয়, আর কখন শেষ হয়, তা বলা মুশকিল। পিচঢালা কংক্রিটের পথ শেষে মাটির রাস্তা দিয়ে কিছুদূর পার হলেই সাহাপাড়ার পুরাতন জমিদার বাবুর বাড়ির সঙ্গে অরণ্যদের নতুন বাড়ি।
বাড়িতে প্রবেশ করেই সে একটু অবাক হলো, লোহার সদর দরজা খোলা, সচরাচর এমন হয় না। লোহার গেট দিয়ে ঢুকেই মাকে ডাকতে লাগল অরণ্য। মা, মা, তুমি কেথায়? গেট তো খোলা? পলাশ কি চলে এসেছে স্কুল থেকে, নাকি বাবা দোকান থেকে চলে এল আজ দ্রুত? মা, তুমি কোথায়? উঠান থেকে আরও কয়েকবার ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে অরণ্য ঘরে প্রবেশ করল। তার মনে হঠাৎ কিছুটা ভয় কাজ করছে, কিছু হলো না তো আবার বাড়ির কারও? এত চুপচাপ কেন সবকিছু?
অরণ্য একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। তার ছোট ভাই পলাশ ক্লাস সিক্সে পড়ে। আর মির্জাপুর বাজারে তার বাবার একটি বড় মুদিদোকান আছে। রোজ বিকেলে তার বাবা বাড়িতে খেতে আসে, তাই আজ দ্রুত দুপুরে চলে এল কি না, গেট খোলা দেখে তার মনে কৌতূহল হলো।
ঘরে ঢুকেই অরণ্য দেখল, তার মা কী যেন একটা জিনিস খুঁজছে একমনে। ড্রয়িংরুমের এখানে–ওখানে এটা–ওটা পড়ে আছে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। মনে মনে সে নিশ্চিত হলো যে যাক, যা ভাবছিল সে রকম কিছু না। হয়তো মা জরুরি কিছু খুঁজছে, তাই খেয়াল করেনি যে সদর দরজা খোলা।
এদিক–সেদিক চেয়ে অরণ্য বলল, মা, তুমি এমন করে কী খুঁজছ, সদর দরজা তো খোলা, পলাশ কি চলে এসেছে, নাকি বাবা এসে গেছে? তার মা নিশ্চুপ। অরণ্য একটা চেয়ার টেনে বসে আবার বলতে লাগল, আজ বাবা এলে বলবে, আমাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিতে। ক্লাসের অনেকের কাছে মুঠোফোন আছে, আমার শুধু নেই। কত কাজে এখন মুঠোফোন লাগে, তোমরা তো বোঝ না। কিন্তু অরণ্যর মা কণিকা রানী যেন কোনো কিছু শুনেও শুনতে পেলেন না, এমন ভাব করে তিনি নিজের মতো কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছেন। অরণ্য আবার বলল, মা, তুমি কি শুনতে পারছ, আমি কী বলছি? মায়ের কোনো সাড়া না পেয়ে অরণ্য তার নিজের রুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস বদলিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে সে আবার তার মাকে ডাকতে ড্রয়িংরুমে এল। মা, খিদে পেয়েছে, খেতে দাও, পলাশও এসে গেছে। মা, আমাদের খেতে দাও।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
এবার কণিকা রানী কথা বলেন, টেবিলে খাবার রাখা আছে, ছোট ভাইকে ভাত বেড়ে দিয়ে তুই নিজে নিয়ে খেয়ে নে। আমি এখন খাবার বেড়ে দিতে পারব না, বাবা। আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস খুঁজছি। আমাকে জ্বালাস না।
অরণ্য বেশ হবাক হলো, তার মাকে সে এভাবে কখনোই দেখেনি। কলেজ থেকে আসার পর প্রতিদিন তার মা–ই খাবার বেড়ে ডাকতে থাকে। আজ এমন কী হলো? কী এমন হারিয়েছে মায়ের যে মা সব ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজছেন? এসব ভাবতে ভাবতেই অরণ্য ছোট ভাই পলাশকে নিয়ে খেতে বসল। খাবার খেয়ে এসে দেখে, তার মা কণিকা রানী সোফায় চুপ করে বসে আছেন, চোখ দুটি মাটির দিকে। কান্না করছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না, তবে মন খারাপ, এটা বোঝা যাচ্ছে।
অরণ্য ধীরে ধীরে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। মায়ের ডান কাঁধে একটা হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল, মা, তোমার কী হয়েছে, তোমার এমন কী হারিয়েছে যে তুমি এভাবে সব জায়গায় খোঁজাখুজি করছ? কিছুক্ষণ চুপ থেকে কণিকা রানী বলেন, কিছু না বাবা, তুই বুঝবি না। খেয়েছিস তো, এবার গিয়ে পড়তে বস, তোর মাস্টার আসবে পড়াতে। পলাশ কি ঘরে আছে নাকি খেলতে মাঠে গেছে?
অরণ্য বলল, ‘পলাশ মাঠে গেছে মা। আমার পড়তে ইচ্ছা করছে না, স্যার আজ আসবে না, শুক্রবার। এবার তুমি বলো তো, তুমি কী খুঁজতেছ। আমার খুব জানার ইচ্ছা হচ্ছে, বলো না মা?
কণিকা রানী বলেন, আমার লেখা একটা ডায়েরি খুঁজে পাচ্ছি না। আলমারিতেই ছিল, কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। তোদের রুমে খুঁজলাম, আমাদের রুম, গেস্টরুম, ড্রয়িংরুম। না, কোথাও খুঁজে পেলাম না।
অরণ্য প্রায়ই লক্ষ করেছে, তার মা রাতে ঘুমানোর আগে কিংবা অবসরে ডায়েরি লেখেন। কিন্তু কাউকে পড়তে দেন না। তাই কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে বলল, সামান্য একটা ডায়েরির জন্য তুমি এত খোঁজাখুঁজি করছ মা? নতুন একটা কিনে আনলেই তো হয়। কী এমন আছে এই ডায়েরিতে?
কণিকা রানী বলেন, তোদের কাছে ডায়েরি বিষয়টা সামান্য হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। আমার আনন্দ, দুঃখ–কষ্টের ভাগীদার হলো এই ডায়েরিগুলো। যেগুলোয় আমি আমার নিজের কথাগুলো লিখে থাকি।
ডায়েরিগুলো এত প্রিয় কেন তোমার মা? লেখো দেখি, কিন্তু কেন লেখো, কী লেখো, কিছুই বলো না। খুব জানতে ইচ্ছা করে, আজ বলবে মা?
ঠিকানা লেখার চেয়ে কেন জানি আমার চিঠি লিখতে বেশি ভালো লাগত। আমি নিজের মনের মতো করে চিঠি লিখতাম।
কণিকা রানী বলেন, তাহলে শোন, বিয়ের কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন আমাদের মামার বাড়িতে থাকতাম। আমার তখন বিয়ের বয়স চলছিল। পড়াশোনা তেমন করিনি বলে পাত্রপক্ষের সামনে যাতে তা ধরা না পড়ে, তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আমাকে ঠিকানা লিখতে শেখানো হয়েছিল। দেখতে গায়ের রং শ্যামলা ছিল বলে সমস্যা ছিল একটু বেশি। তার মধ্যে আবার একদমই পড়াশোনা না জানলে তো বিরাট সমস্যা। তাই ছেলেপক্ষ দেখতে এলে যাতে অন্তত ঠিকানা লিখতে পারি, তাতে মেয়ে উদ্ধারের কাজটা হয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে আমার মাস ছয়েক লেগে গিয়েছিল চিঠি লেখা পর্যন্ত শিখতে। নতুন করে প্রথমে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ আর পরে সংখ্যা ও ইংরেজি ২৬টি বর্ণমালা শিখতে হয়েছে। তারপর বাংলায় বাক্য গঠন শেখার পর আমার মূলকাজ শুরু হয়েছিল ঠিকানা লেখা আর চিঠি লেখা শেখা। ঠিকানা লেখা শেখা ছিল আমার জন্য বাধ্যতামূলক কাজ। কারণ, পাত্রী দেখতে এলে ঠিকানাই লেখানো হতো আমাদের সময়ে। আমাকে যিনি এসব শেখাতেন, তিনি সম্পর্কে আমার দিদা হোন, আমার মায়ের দূরসম্পর্কের কাকিমা। মা যখন মামার বাড়িতে আমাকে দেখতে আসতেন, তখন দিদাকে টাকা দিয়ে বলে যেতেন, আমাকে পড়ালেখা শেখানোর জন্য।
ঠিকানা লেখার চেয়ে কেন জানি আমার চিঠি লিখতে বেশি ভালো লাগত। আমি নিজের মনের মতো করে চিঠি লিখতাম। যদিও কাউকে দিতাম না, দেখাতাম না, শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে রেখে দিতাম। বাবা যখন মাঝেমধ্যে দেখতে আসতেন, তখন প্রায়ই ডায়েরি কিনে দিয়ে যেতে মর্জি করতাম, তিনি সময় সুযোগ করে ডায়েরি কিনে দিয়ে যেতেন, সেই থেকে লেখা। আমি প্রতিদিন কী করতাম, তা–ও লিখতাম। এভাবেই চলছিল।
আমার অপরাধ কী ছিল, তা জানি না। আমাকে মামার বাড়িতে রাখা হতো। গরিব মা–বাবার সংসারে আরও তিন ভাইবোন আর ঠাকুরমা মিলে ভরণপোষণের ঘাটতি ছিল কি না বলতে পারব না। তবে নিজের পরিবার ছাড়া আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ মামার বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেও সুখকর ছিল না। নিত্য মামা ও মামিদের অবহেলার শিকার হওয়া ছাড়া আমার কপালে ভালো ব্যবহারও জুটত না। কান্না করতাম লুকিয়ে, আর ভাবতাম আমায় কেন বাড়ি নিয়ে যায় না মা-বাবা, কিন্তু তাতে কিছুই হতো না। কারণ, আশ্রিতদের কান্না হয়তো সৃষ্টিকর্তাও শোনেন না।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ২০০১–২০০২ সালের দিকের। তারপর আমার বিয়ে হয়ে যায় তোর বাবার সঙ্গে। এর পর থেকে তো এই সংসারেই আছি। প্রতিদিন নানা কাজের চাপেও আমি একবার ডায়েরি লেখার চেষ্টা করি। ওই যে বিয়ের জন্য লেখাপড়া করা শিখেছিলাম, চিঠি লিখতে শিখেছিলাম, সেটা এখনো চলমান রাখি। তোরা দুই ভাই আমার ঘর আলো করে এলি। শত ঝামেলার মধ্যেও ডায়েরি লেখা নিয়মিত করতাম আর শেষ হওয়া ডায়েরিগুলো আমি যত্ন করে রাখতাম। কিন্তু এর মধ্যে একটি ডায়েরি হঠাৎ আজ খুঁজে পাচ্ছি না।
অরণ্য বলল, এখন কেউ চিঠিপত্র বা ডায়েরি লিখে না মা। মেইল করে, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে, অডিও–ভিডিও কলে কথা বলে। তুমি এখনো সেকেলে রয়ে গেলে মা, আধুনিক হলে না।
কণিকা রানী বলেন, তোদের কথা শুনে সত্যিই আমার হাসি পাই রে। তোদের কীভাবে বোঝাই যে এ সংসারে প্রবেশের অন্যতম অলিখিত শর্ত ছিল লিখতে ও পড়তে জানা। আমি যে ওটাই যতটুকু ভালোভাবে শিখেছিলাম মন দিয়ে, এখনো সেটা চলমান রাখার চেষ্টা করি।
অরণ্য বলল, শুনলাম, কিন্তু মা, এসব তুমি এখন বাদ দাও তো। তুমি বরং বাবাকে বলো, তোমাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিতে। তুমি টাইপ করে নোটপ্যাডে লিখে রাখবে, আমি তোমায় টাইপ করা শিখিয়ে দেব। এখন ভাত খাও তো গিয়ে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সকাল থেকে এখনো খাওনি।
কণিকা রানী বলেন, হ্যাঁ, যাই রে, খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু বাবা অরণ্য, আমার কলম দিয়ে লিখতেই ভালো লাগে রে, মুঠোফোনের ব্যবহার তো জানি না, কেমন হয় তা বলতে পারছি না। আচ্ছা অরণ্য, পলাশ আবার আলমারি থেকে ডায়েরি নিয়ে কোথাও ফেলে দেয়নি তো ভুল করে? ওর তো আবার এসব করার অভ্যাস আছে।
অরণ্য বলল, তুমি যে কী বলো না মা, আলমারিতে তুমি সব সময় তালা দিয়েই রাখো। ও খুলবে কীভাবে, চাবি তো থাকে তোমার কাছে?
কণিকা রানী বলেন, তা–ও ঠিক। আচ্ছা, তোর বাবা আবার ধরেননি তো দোকানের খাতা ভেবে? এমন তো উনি কখনো করেন না। আমিই তো খাতা বের করে দিই সব সময়।
অরণ্য বলল, বাবার কথা আমি বলতে পারব না। মা, তুমি জিজ্ঞাসা করে নিয়ো।
কণিকা রানী বলেন, হ্যাঁ, সেটাও তো কথা। আচ্ছা যাই তাহলে, স্টোররুমটা একবার দেখে আসি গিয়ে শেষমেশ। যদি পাই, তারপর নাহয় খেতে বসব। আচ্ছা তবুও শোন, এর মধ্যে তোর বাবা এলে জিজ্ঞাসা করিস তো, আমার ডায়েরি ধরেছেন কি না।
আচ্ছা, ঠিক আছে বলে রিমোট দিয়ে টিভি চালু করে দেখতে লাগল অরণ্য। আর তার মা শেষ চেষ্টা হিসেবে স্টোররুমে ডায়েরি খুঁজতে গেলেন।
লেখক: হৃদয় গোপাল সাহা, হাজীপুর, নরসিংদী