ক্ষণিক আলাপ

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সকালের টিউশনি শেষ করে নরসিংদী স্টেশনে এসে একটি দৈনিক পত্রিকা কিনল বিমল। সামনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা, তাই সাজেশনও কিনতে হবে; কিন্তু মাসের শেষে টিউশনির টাকা না পেলে হাতখরচ চালানোটাই মুশকিল হয়ে যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে লাগল বিমল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মানুষের ভিড় এড়িয়ে একটি সাইডে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের পিলারের সঙ্গে তৈরি করা বসার স্থানে বসল সে। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দুই পাশে ভাজাপোড়া আর চায়ের দোকানসহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান থাকলেও মাঝখানের জায়গাটা কিছুটা শান্ত। বিমল সেখানেই বসে পত্রিকা পড়তে শুরু করল।

হঠাৎ অচেনা একজন তাকে ডাক দিল, ‘এই যে ভাইয়া, তিতাস ট্রেন কি চলে গেছে?’ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল বিমল, কলেজড্রেস পরা একজন তরুণী। ড্রেস দেখে বোঝা যাচ্ছে সম্ভবত প্রাইভেট কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। বিমল প্যান্টের পকেট থেকে মুঠোফোন খুলে সময় দেখে বলল, ‘না, এখনো যায়নি। আসবে কিছুক্ষণ পর। আপনি কোথায় যাবেন?’

মেয়েটি বলল, ‘আমি মেথিকান্দা যাব, ভাইয়া।’

বিমল বলল, ‘ও আচ্ছা। তাহলে অপেক্ষা করুন। ট্রেন আসতে এখনো অনেকটা সময় রয়েছে।’

বিমলের পাশে খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কি এখানে বসতে পারি? বিমল বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই, বসুন। বিমল কিছুটা সরে গিয়ে জায়গা করে দিল আর বলল, ‘এগুলো সরকারি বসার জায়গা, বসার জন্য কারোর অনুমতির প্রয়োজন নেই। খালি পেলে শুধু বসে যাবেন।’ মেয়েটি বসে বিমলের কথা শুনে একটু হাসল আর বলল, ‘আমি আপনার জুনিয়র হব নিশ্চিত, আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’

বিমল বলল, ‘হ্যাঁ, এটা অবশ্যই তুমি মন্দ বলোনি। তা তোমাদের বাড়ি বুঝি মেথিকান্দা?’

মেয়েটি বলল, ‘না, ভাইয়া। আমাদের বাড়ি নীলক্ষা। নিশ্চয়ই নাম শুনেছেন, ওই যে দুই গ্রামের মানুষ মাঠে নেমে মারামারি করে, সে এলাকায়।’

বিমল বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। টেঁটাযুদ্ধ হয় শুনেছি এখনো, বিখ্যাত এলাকা, না চিনলে হয়? কিন্তু ট্রেনে কি মেথিকান্দা গিয়ে নীলক্ষা যাবে? আমি যতদূর জানি, নরসিংদী স্টেশন থেকে অল্প দূরত্বে আরশীনগর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাওয়া যায়। তুমি তো সরাসরি সিএনজি দিয়েই যেতে পারো। ট্রেনের জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা আবার সিএনজি আর সাথে ভোগান্তি ত আছেই।’

মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ, ভাইয়া, আপনি ঠিক বলেছেন। তবে আমি এখন আমাদের বাড়ি যাব না, মেথিকান্দা যাব। আপনিও কি ট্রেনে কোথাও যাবেন?’

বিমল বলল, ‘না, আমি ট্রেনে কোথাও যাব না। আমি এমনিতেই প্রায়ই সময় পেলে এখানে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকি, পত্রিকা পড়ি, ভালো লাগে, মানুষ আর ট্রেন দেখি। আর আজ একটু কলেজ রোডের জননী লাইব্রেরিতে যাব। একটি বইয়ের খোঁজ করতে হবে, তাই এদিকে আসা।’

মেয়েটি বলল, ‘ভারি অদ্ভুত মানুষ তো আপনি। পত্রিকা আর বইয়ের খোঁজ না হয় বুঝলাম; কিন্তু ট্রেন আর মানুষ দেখার জন্য কেউ স্টেশনে এসে বসে থাকে, সেটা আজ প্রথম শুনলাম। আজব ব্যাপার।’

বিমল বলল, ‘তোমার কাছে আজব মনে হলেও অনেকের কাছে এটাই অনেক কিছু। আচ্ছা, এত কথা হচ্ছে তোমার নামটা জানা হলো না। তোমার নাম কী? কী সে পড়ো?’

মেয়েটি বলল, ‘আমার নাম জান্নাতুল হিমিকা। পশ্চিম ব্রাহ্মদীর বালুচরে একটি প্রাইভেট কলেজে ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছি। আজ কলেজ থেকে টিসি নিতে এসেছিলাম; কিন্তু স্যাররা দিলেন না। এখন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবাইকে কী বলব, তা নিয়ে ভাবছি।’

শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে বিমল কিছুটা অবাক হলো। এটুকু একটি মেয়ে বলছে কি না শ্বশুরবাড়ি যাবে কলেজ শেষে। ব্যাপারটা কী, কেমন যেন খটকা লাগছে তার। তাই বিমল মেয়েটিকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি বিবাহিত হিমিকা?’

হিমিকা বলল, ‘জি ভাইয়া, গত মাসেই আমার বিয়ে হয়েছে। সৌদিপ্রবাসী ছেলের সাথে।’

বিমল কি বলবে বুঝতে পারছে না। মেয়েটিকে দেখে এখনো বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। আর এই মেয়ে নাকি বিবাহিত। বয়স যে ১৮ হয়নি তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিমল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আচ্ছা হিমিকা, বিয়েতে তখন তোমার মত ছিল?

হিমিকা বলল, ‘মেয়েদের ইচ্ছা–অনিচ্ছার কি কোনো দাম আছে এই সমাজে, তা–ও আবার বিয়ের ক্ষেত্রে।’

বিমল বলল, ‘কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। অবশ্যই মেয়েদের মতামত নেওয়া হয় এবং নেওয়াটাই উচিত। তবুও সবারই তো নিজের একটা চাওয়া বা মতামত থাকে। তোমার কি কিছুই বলার ছিল না?’

হিমিকা বলল, ‘না, ভাইয়া। আমার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমি বিয়েটা করতে চাইছিলাম না। আমার এসএসসিতে রেজাল্ট ভালো ছিল। আমি পড়াশোনা করতে চেয়েছিলাম। বিয়ের আগে বলেছিল পড়াশোনা করাবে। আমার আপন তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাইও এ ব্যাপারে জোর দিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর সবাই কেমন যেন বদলে গেল।’

বিমল বলল, ‘তাহলে এখন কি তুমি আর পড়াশোনা করতে পারবে না; কিংবা তোমার শ্বশুরবাড়ির লোক আর স্বামী চান না বলে তুমিও করতে চাও না। বিষয়টা কি এমন?’

হিমিকা বলল, ‘না, ভাইয়া। আমি চাই, কিন্তু পরিস্থিতি কোনোভাবেই আমার দিকে আসছে না। তবুও আমি অনিয়মিত কলেজ করছি। কারণ, স্বামী চায় না আমি পড়াশোনা করি। বিয়ের সপ্তাহখানেক পরই স্বামী বলল, নরসিংদী গিয়ে পড়াশোনা করার দরকার নেই। কলেজ থেকে টিসি নিয়ে আসবা। গ্রামের কলেজে ভর্তি করাব। না ভর্তি করাতে পারলে নেই, পড়াশোনা করতে হবে না। আমি জানি, নরসিংদী ছাড়লে গ্রামে আমার পড়াশোনা হবে না; কিন্তু সামাল দিতে না পারায় আর অবস্থা বেগতিক বলে আজ টিসির জন্য স্বামী সকালে সঙ্গে এসেছিল।’

হিমিকার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটি ট্রেন ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ৩ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়াল। সে উঠে দাঁড়াল ট্রেনে ওঠার জন্য, তখন বিমল বলল, ‘এটা কর্ণফুলী ট্রেন, তিতাস না। তিতাস ট্রেন একটু পর আসবে। তুমি তাড়াহুড়া কোরো না, এখানে বসো।’ মেয়েটি বসল।

মেয়েটি চুপ করে বসে রইল। বিমল বলল, ‘চা খাবে?’ মেয়েটি কোনো উত্তর দিল না। শুধু মুখটা তুলে তাকাল আর মাথাটা নিচু করে বসে রইল। বিমল আবার বলল, ‘আরে তোমাকে তো আমার নামই বলা হয়নি। আমার নাম বিমল ঘোষ। চাকরিও করিনি, ঘুষও খাই না, তবুও নামের শেষে টাইটেল ঘোষ, ব্যাপারটা মজার না!’ বিমল জানে সে নিজে কাউকে হাসানোর জন্য জোকস করতে পারে না, তবুও মাঝেমধে৵ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

তবুও মেয়েটি একটু মুচকি হাসল। তারপর বিমলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানেন ভাইয়া, আমার পড়াশোনাটা আর হবে না, আমি জানি। আমাদের ক্লাসে আরও কয়েকটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তারা আর ক্লাসে আসে না। আমারও তাদের মতো অবস্থা হবে। তিন ভাইয়ের এক বোন আমি; আর মা-বাবার একমাত্র কন্যাসন্তান। তাই ভেবেছিলাম, অন্তত ইন্টার পর্যন্ত পড়তে পারব; কিন্তু সেটিও হলো না। অন্য বান্ধবীদের মতো আমাকেও গৃহিণী হতে হবে।’

বিমল সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘এভাবে ভেঙে পড়লে হবে, কতটুকুই–বা বয়স তোমার। তুমি চাইলেই পড়তে পারবে, চেষ্টা করেই দেখো না কী হয়।’

হিমিকা বলল, ‘না ভাইয়া হবে না। আমার স্বামী নিজেও পড়াশোনা বেশি করেনি। ওদের পরিবারে পড়াশোনা নিয়ে কারও তেমন আগ্রহ নেই। তাই আমার পড়াশোনা যে আর হবে না, সেটি বিয়ের পর কয়েক দিনের মধ্যেই আমি বুঝে গেছি। বোঝার পরও মনে হলো শেষ চেষ্টা করি, তবে বেশি কিছু করতে পারব বলে সাহস পাচ্ছি না।’

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চুপ থেকে বিমল বলল, ‘তুমি আমাকে এসব কথা বলছ কেন? আমি তো অপরিচিত একজন লোক।’

হিমিকা বলল, ‘বলতে চাইনি, মুখ ফুটে বের হয়ে যাচ্ছে। কত আর চাপা রাখব সব কথা বলেন তো। আর আপনি শুনলেই বা কী হবে। তবুও ইচ্ছা হচ্ছে, তাই বলি, শুনুন—বিয়ে ঠিক হওয়ার পর কলেজে জানিয়েছিলাম, স্যারদের অনুরোধ করেছিলাম বিয়ে বন্ধ করার জন্য; কিন্তু তাঁরা কিছুই করলেন না, উল্টো বললেন, পারিবারিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা কলেজের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।’

‘তা তুমি একাই চলাচল করো এখনো, সঙ্গে কেউ আসে না’ বিমল জিজ্ঞাসা করল। হিমিকা বলল, ‘আগে আসেনি, বিয়ের আগে আমি বান্ধবীদের সঙ্গে চলে আসতাম। বিয়ের পর মাঝেমধে৵ দেবর কিংবা আমার ভাইয়েরা কেউ সঙ্গে আসত। আজ আমার স্বামীই এসেছিল; কিন্তু কলেজ থেকে টিসি দেয়নি বলে জিদ করে চলে গেছে। যাওয়ার সময় বলেছে, মেথিকান্দা স্টেশনে অপেক্ষা করবে, আমি যেন তিতাস ট্রেনে চলে যাই। সিএনজিতে করেই যেতাম; কিন্তু স্বামী বলল, তাই ট্রেনে যাচ্ছি। কথা না শুনলে সে রেগে যায়।’

স্টেশন মাস্টার মাইকিং করছেন, ‘ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মেথিকান্দা, ভৈরব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী তিতাস কমিউনিটার ট্রেনটি অল্পকিছু সময়ের মধ্যে ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ৩ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়াবে। যেসব যাত্রী এখনো টিকিট কাটেননি, তারা অতিসত্বর কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে রেলভ্রমণ করুন। বিনা টিকিটে রেলভ্রমণ দণ্ডনীয় অপরাধ।’

হিমিকা উঠে দাঁড়াল, কাঁধের ব্যাগটা ঠিক আছে কি না দেখল। ট্রেন চলে এসেছে। ধীরে ধীরে থেমে থেমে স্থির হলো ট্রেনের বগিগুলো। ভিড় ঠেলে মানুষ নামছে আর উঠছে। হিমিকা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, যাই ভাইয়া, আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি সত্যি পড়াশোনাটা করতে চাই, আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব। আমি চেষ্টা করব টিকে থাকার।’

শেষের বাক্যগুলো শুনে মনে হলো, এই মেয়ে তো আর বাচ্চা নয়, কেমন পরিণত হয়ে গেছে। বিয়ের পর হয়তো মেয়েরা এমনই হয়। বিমল প্রত্যুত্তরে বলল, ‘ভালো থেকো হিমিকা। পড়াশোনাটা কোরো আর মাঝেমধে৵ নরসিংদী স্টেশন এলে হয়তো আমায় পাবে, আবার দেখা হবে।’

হিমিকা ট্রেনে উঠে গেল। গাড়িতে অনেক ভিড়, সম্ভবত সে ভেতরে চলে গেছে। আর দেখা যাচ্ছে না তাকে। গাড়ি হুইসেল দিল আর ঝকমক শব্দ করে এগিয়ে চলল। ট্রেনটি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। বিমল উঠে দাঁড়াল আর হাঁটা শুরু করল। সে ভাবছে, হিমিকা কি সত্যিই পড়াশোনাটা করতে পারবে, নাকি অনেকের মতো সে–ও ঝরে যাবে? হয়তো যাবে. কিংবা না। ভাবনা শেষ করে অটোরিকশায় উঠল সে, লাইব্রেরি নয়, বাজারে যেতে হবে তাকে, তরিতরকারি আর কিছু মুদিসদাই কিনে বাড়ি ফিরতে হবে। বাইরে ভীষণ রোদ। তিন দিন ধরে করব করব করে বাজার করা হচ্ছে না। আজ না করলে মায়ের বকুনি থেকে নিস্তার নেই বিমলের। বাজার করেই ফিরতে হবে।

লেখা : হৃদয় গোপাল সাহা, হাজীপুর, নরসিংদী।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]