শব্দের পিছু পিছু—সুর-শিল্পের স্বর্গালয়ে
শীতের সন্ধ্যাগুলো অকারণেই একটু ধীর হয়ে আসে। হাওয়ায় থাকে হালকা কাঁপুনি, আলো নামে নরম হয়ে; আর মানুষের ভেতরেও অজান্তে জন্ম নেয় থেমে থাকার এক ক্ষুদ্র অভ্যাস। দিনের শেষে শহর যখন নিজেকে গুটিয়ে নেয়, তখন মনটাও যেন হাঁটতে চায় কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই। তেমনি এক শীতের সন্ধ্যায় রাজধানীর ইউনাইটেড সেন্টার পয়েন্টে ঢুকেছিলাম। দিনভর জমে থাকা ক্লান্তিটুকু ঝেড়ে ফেলে, একটু হাঁটার ইচ্ছায়। খুব সাধারণভাবেই শুরু হয়েছিল সন্ধ্যাটা। কোনো বিশেষ প্রত্যাশা ছিল না, কোনো প্রস্তুতিও নয়।
হাঁটতে হাঁটতেই কানে এল এক টুকরা সুর। দূর থেকে ভেসে আসা সরোদের টান, তার সঙ্গে তবলার সংযত সংগত। শব্দটা খুব জোরে নয়, আবার উপেক্ষা করার মতোও নয়। ঠিক যেমন বহুদিনের চেনা কোনো মানুষ হঠাৎ নাম ধরে ডাকে। সেই ডাকে যেমন না-সাড়া দিয়ে থাকা যায় না, তেমনি এই সুরও উপেক্ষা করতে পারলাম না। শব্দের অনুরণনে উদ্বেলিত মন শব্দকেই অনুসরণ করল—অজানা একদিকে।
চোখে পড়ল দেয়ালজুড়ে নকশিকাঁথার আবরণ। সেলাইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে জমে আছে বাংলার ছড়ানো–ছিটানো হাজার বছরের গল্প, মায়ের অপেক্ষা, নারীর শ্রম, আর লোকজ নান্দনিকতা। যান্ত্রিক শহরের ভেতরে দাঁড়িয়ে এই নকশিকাঁথা যেন মুহূর্তেই চোখের সামনে এনে দিল মাঠ-ঘাট, তেপান্তর, মাটির উঠোন, আরও কত কী! সেই দেয়ালের পাশেই সাজানো ছোট-বড়, রঙিন-ধূসর, বাহারি সব চিত্রকর্ম—কোথাও তীব্র প্রতিবাদ, কোথাও বিষণ্নতা, কোথাও নিছক সৌন্দর্যের আরাধনা। মনে হলো দেয়াল কথা বলছে রঙের বাহারে, তুলির আঁচড়ে।
ভূমি গ্যালারির ভেতরে ঢুকে সময় আরও থমকে গেল। বাইরের শহরের যান্ত্রিকতা, ব্যস্ততা, কোলাহল সবকিছু পড়ে রইল দরজার ওপারে। আলো-আঁধারির খেলায় দুই তরুণ শিল্পী—একজন সরোদে, অন্যজন তবলায়—সুর, তাল আর লয়ের এমন এক আবহ তৈরি করেছেন, যেন পৃথিবীর সব কোলাহলকে মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেন–জি সরোদ বাদক অর্জুন আর জেন আলফা তবলা বাদক ওমের হাতে তখন যন্ত্র শুধু বাজছিল না, তারা কথা বলছিল কখনো তুমুল প্রতিবাদে কখনো গভীর অনুভবে।
মনে পড়ল জে জি বেইনার্ডের উক্তি, ‘সংগীত হচ্ছে শাশ্বত, যার দেশ, কাল, পাত্রভেদে অভিন্ন।’ ঠিক সেটাই ঘটছিল সেখানে। বয়সের ব্যবধান, প্রজন্মের ফারাক—সব মুছে গিয়ে সংগীত হয়ে উঠেছিল একমাত্র পরিচয়। ভূমি গ্যালারিতে বসেছিল সুরের স্বর্গীয় আসর।
এই সংগীত আয়োজনটি কোনো আলাদা সংযোজন নয়; বরং পুরো প্রদর্শনীর ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখা যায়, গ্যালারির দেয়ালে তখন শত শত শিল্পকর্ম। ১১৪ জন শিল্পীর ৩৫০টি সৃজন, যেন কালের দীর্ঘ সেতু। জয়নুল আবেদিনের দৃঢ় রেখা, কামরুল হাসানের বিদ্রূপ, আবার বর্তমান সময়ের শিল্পীদের দ্বিধা, প্রশ্ন আর ক্ষোভ—সব একসঙ্গে উপস্থিত। তবু কোথাও ভিড় লাগেনি। প্রত্যেকটি কাজ নিজের জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্বতন্ত্র আভিজাত্যে।
পুরো আয়োজনে একবারও মনে হয়নি, এটা আলাদা করে কিছু দেখানোর চেষ্টা করছে। ছবিগুলো দেয়ালে ছিল, সরোদ-তবলার সংগত চলছিল—সব নিজের মতো করেই। কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যেতে চাইছিল না। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সরোদের সুর কানে ঢুকে গেল, খেয়ালই করিনি। আবার গান শুনতে শুনতে চোখ আটকে গেল কোনো একটা ক্যানভাসে। মনে হলো কানে কানে কেউ বলে গেল, শিল্প কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। চিত্র, সংগীত, নকশা, সাহিত্য—সবই একে অপরের পরিপূরক।
ইউনাইটেড সেন্টার পয়েন্টে ভূমি গ্যালারির নতুন এই শাখাটি সাময়িক আয়োজন নয়; এটি স্থায়ী—ঠিক যেমন বাংলার শিল্প-সাহিত্যের উত্তরাধিকার। ৩৫০০ স্কয়ার ফিটের এই গ্যালারিতে এখন থেকে চলবে বাংলার শিল্প-সাহিত্যের নিয়মিত চর্চা। মাঝেমধ্যে উদ্যাপিত হবে বিশেষ প্রদর্শনী, বছরের বাকি সময় প্রতি মঙ্গলবার থেকে রোববার, দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য খোলা থাকবে এই গ্যালারির দুয়ার।
ঢাকায় শিল্পচর্চার পথ এখনো বেশির ভাগ সময় ধানমন্ডি, চারুকলা বা শিল্পকলা একাডেমির দিকেই বয়ে চলে। দূরত্ব, যানজট আর সময়ের চাপে যাঁরা সেখানে নিয়মিত পৌঁছাতে পারেন না, বিশেষ করে গুলশান, বনানী, বারিধারা, ক্যান্টনমেন্ট কিংবা উত্তরা এলাকার মানুষ, তাঁদের জন্য ইউনাইটেড সেন্টার পয়েন্টে ভূমি গ্যালারির নতুন ঠিকানাটি যেন শিল্পের সঙ্গে মানুষের দূরত্বটা অনেকটা কমিয়ে দেয়। অফিস শেষে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় এসে, কেনাকাটার ফাঁকে বা নিছক একটু হাঁটতে এসে হঠাৎই শিল্পের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া এই অপ্রস্তুত মুহূর্তগুলোই এখানে শিল্পকে আরও কাছের করে তোলে।
সেদিন ভূমি গ্যালারিতে কেউ বক্তৃতা দেয়নি, কেউ বোঝাতে চায়নি শিল্প কত বড় বা গুরুতর বিষয়। নকশিকাঁথার আবহে সাজানো গ্যালারির বাইরের দেয়াল আর ভেতরের চিত্রকর্মের সারি, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, এই আয়োজন আমাদের একটু থামানোর জন্যই। আধুনিক যন্ত্রের ভিড়ে আমরা যে তাল, লয়, ঝংকার ভুলে যাচ্ছি, তার কথাই যেন নীরবে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]