মাউন্টব্যাটেনের ক্ষোভ, খণ্ডিত বাংলা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৪৬ সালের শেষের দিক থেকে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার যেকোনোভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চায়। বড়লাট ওয়েভেল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দিলেন। মুসলিম লীগের সঙ্গে ওয়েভেল খারাপ আচরণ করেছেন। এ জন্য মুসলিম লীগ যোগ দিল না। কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস যোগ দিল। তবে ওয়েভেল মুসলিম লীগের পাঁচ মন্ত্রীর যোগদানের সুযোগ রাখলেন। তাঁরা যেকোনো সময় যোগ দিতে পারেন। জিন্নাহ-ওয়েভেলের আলোচনার ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রিগড়, আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী খান ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিলেন।

মুসলিম লীগ যদি অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ না দিত, তাহলে কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রে আদৌ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হতো কি না, সেটা ছিল এক বিরাট প্রশ্ন। ১৯৪৭ সালের জুনে ঘোষণা হলো, ভারতবর্ষের ভাগ হবে। কংগ্রেসের ইচ্ছা অনুযায়ী বাংলা ও পাঞ্জাবের ভাগ হবে। সে অনুসারে আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবে না। অবিভক্ত বাংলার কলকাতা ও এর আশপাশের এলাকা ভারতবর্ষে থাকবে। মাওলানা আকরাম খাঁসহ মুসলিম লীগের নেতারা বাংলা ভাগের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। সবার প্রায় একটাই প্রশ্ন, অন্যান্য জায়গা না পেলেও কলকাতা কেন পাওয়া যাবে না? এদিকে হিন্দু মহাসভা বাংলা ভাগের জন্য জনমত সৃষ্টি করছে। সাধারণ কর্মীরা জানতেন না যে দিল্লিতে বসে বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা কেটে হিন্দুস্তানে দেওয়া হয়েছে, কলকাতা দেওয়া হয়েছে। যদি গণভোটে জয় লাভ করে, তাহলে শুধু সিলেট জেলা পাকিস্তানে আসবে।

এ সময় মুসলিম লীগের থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম আর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায় আলোচনায় বসেন। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা ঠিক করেন যে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। জনসাধারণের ভোটে একটা গণপরিষদ হবে। সেই পরিষদ ঠিক করবে যে বাংলাদেশ পাকিস্তানেও যেতে পারে, ভারতেও যেতে পারে আবার স্বাধীনও থাকতে পারে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লিতে গেলেন।

জিন্নাহ বললেন, কংগ্রেস রাজি হলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। এদিকে ব্রিটিশ সরকারেরও একই কথা, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ একমত হলেই তারা মানতে পারবে। শরৎ বসু তখন গেলেন গান্ধী ও পণ্ডিত নেহরুর কাছে। তাঁরা শরৎ বসুকে সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের কাছে পাঠালেন। প্যাটেল তাঁকে খুব অপমানই করলেন। বললেন, ‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন। কোনোভাবেই কলকাতা ছাড়ছি না।’ গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল অনেক আগেই ঠিক করেছেন যে তাঁরা কলকাতা ছাড়বেন না। অথচ মুসলমানদের আন্দোলন ছিল, বাংলা ও আসাম দুটো প্রদেশই যেন পাকিস্তানে যোগদান করতে পারে। মাওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর রক্তের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের ভাগ হবে। তিনি তাঁর জীবন থাকতে বাংলাদেশে ভাগ করতে চাননি।

আরও পড়ুন

লর্ড মাউন্টব্যাটেন চেয়েছিলেন ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হতে। জিন্নাহ তাতে রাজি হননি। জিন্নার উচ্চাভিলাষ, তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হবেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এতে ভীষণ খেপে গেলেন। গোপনে কংগ্রেসকে সাহায্য করে পাকিস্তানের সর্বনাশ করলেন। রেডক্লিফ সীমানা নির্ধারণ করলেও মাউন্টব্যাটেন তাঁকে গোপনে ম্যাপ ঠিক করে দিয়েছিলেন বলে ধারণা ছিল। জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হোক, এটা মুসলিম লীগেরও অনেকে চাননি। প্রথমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, পরে প্রেসিডেন্ট হবেন। মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল থাকলে হয়তো এত বড় অন্যায় হতো না।

দেশ ভাগের চরম বৈষম্য মানতে পারেননি বঙ্গবন্ধু

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন দুইটা পাকিস্তান হবে। অবিভক্ত বাংলা নিয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। এর সীমানা হবে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম। এ অঞ্চলে বসবাসকরী মানুষের একরাষ্ট্রীয় ভাবনাকে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা বা বৃহত্তর বাংলাদেশ বলা হয়। মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধুসহ অনেক বিখ্যাত বাঙালি অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার একনিষ্ঠ সমর্থক। এর ইতিহাসও প্রায় চার হাজার বছরের। পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান। আরেকটা হবে হিন্দুস্তান।

বাংলার প্রায় সব ইতিহাসই বঙ্গবন্ধু জানতেন। কীভাবে ইংরেজরা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, রাতারাতি মুসলমানদের সর্বসান্ত করেছিল, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি সবকিছু থেকে বিতাড়িত করেছিল। ভারতবর্ষে হিন্দু, মুসলমানসহ বহু সম্প্রদায়ের বাস। কিন্তু সব সুযোগ-সুবিধা চলে যাচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে। তাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহিরা বিদ্রোহ করেছে। হাজি শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীরেরা আন্দোলন করেছেন। এসব ইতিহাস তিনি বলতেন আর বক্তৃতা দিতেন। হিন্দুরাও একসময় বুঝতে পারল যে ইংরেজদের তাড়াতে হবে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষ বসু হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। জনাব আবুল হাশিম বলতেন, পাকিস্তান আন্দোলন হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়। হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য। সেই মিল আর হলো না। দূর থেকে আরও দূরে গেল সবাই। লাহোর প্রস্তাবের ‘স্টেটস’ হয়ে গেল ‘স্টেট’।

শুরু হলো গভীর ষড়যন্ত্র। তারপর নাজিম উদ্দিনই শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি একবারও পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের কথা ভাবেননি। মুসলিম লীগ বা অন্য কারও সঙ্গে পরামর্শ না করেই ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার ফলে কলকাতার ওপর পূর্ব বাংলার আর দাবি রইল না। এদিকে তখনো পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা ঠিক হয়নি।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন কলকাতা নিয়ে ভাবনায় পড়লেন। ইংরেজরা তখনো চূড়ান্ত করেনি, কলকাতা হিন্দুস্তানে যাবে, না পাকিস্তানে যাবে। কোনো উপায় না থাকলে একে ফ্রি-স্টেট করা যায় কি না, সেটা নিয়েও ভাবছেন।

আর কলকাতা হিন্দুস্তানে গেলেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার কথা। কারণ, হিন্দুরা কলকাতা পাওয়ার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দেবে। একজন ইংরেজ গভর্নর গরমের জন্য ঢাকায় আসতে চাননি। মাউন্টব্যাটেন তাঁকে লিখেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান দুনিয়ার অন্যতম পাহাড়ি শহর। তার মানে দার্জিলিং পাকিস্তানে আসছে। কিন্তু নাজিমুদ্দিনের ওই ঘোষণায় সব শেষ হয়ে গেল। মাউন্টব্যাটেন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে মুসলিম লীগ মনে হয় রাজধানী ঢাকা হওয়াতেই খুশি। এখন তাদের যা দেওয়া হবে, তা–ই নেবে। তারা আর ঝামেলা করবে না। তখন তিনি সুযোগ পেয়ে যান। যশোর জেলায় অনেক মুসলমান, তারপরও বনগাঁ পাকিস্তানে এল না। নদীয়ায় মুসলিম বেশি, তারপরও কৃষ্ণনগর, রানাঘাট হিন্দুস্তানে চলে গেল। মুর্শিদাবাদও ভারতে গেল। মালদহ জেলায় হিন্দু-মুসলিম সমান, এর অর্ধেক হিন্দুস্তানে অর্ধেক পাকিস্তানে।

দিনাজপুরে মুসলমান বেশি, বালুরঘাট ভারতে গেল। তাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে চলে গেল। এসব জায়গা পাকিস্তানে না আসার কোনো কারণ ছিল না।
আবার সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করার পরও করিমগঞ্জ দিয়ে দেওয়া হলো ভারতকে। অথচ সেখানে মুসলমান বেশি। আসামের কাছাড়ও পাকিস্তানে আসতে হবে। কিন্তু সেটাও এল না। যে কলকাতা পূর্ববঙ্গের টাকায় গড়ে উঠেছে, সেই কলকাতা অনেকটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

সে সময় এটা হয়তো মুসলিম লীগের একটা ষড়যন্ত্র ছিল। কারণ কলকাতা পাকিস্তানে এলে অবধারিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হতো কলকাতা। তখন ভারতের শ্রেষ্ঠ শহর কলকাতা। কলকাতা একবার সারা ভারতের রাজধানীও ছিল। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই সোহরাওয়ার্দী হতেন প্রধানমন্ত্রী। নাজিম উদ্দিনের গ্রুপ এটা কখনো চায়নি। এরা ক্ষমতার লোভে কোনো দেনদরবার না করে যা পেয়েছে, তা–ই নিয়েই খুশি হয়েছে। পূর্ব বাংলার মতো এমন অদ্ভুত মানচিত্র পৃথিবীতে আর আছে কি না, জানা নেই। এটা হওয়ার কারণ ওই নিকৃষ্ট প্রকারের ভাগ। যেখানে মনে হয়েছে, সেখানে ভারতকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আজকের বাংলাদেশের ম্যাপটা হলো উত্তর-দক্ষিণে সরু। পূর্ব-পশ্চিমে কিছুটা পেট মোটা। বঙ্গবন্ধু ভীষণ অনুতাপ করেছেন এমন কাটাছেঁড়া একটা বাংলা পাওয়ার জন্য।

পাকিস্তান অর্জনের পরও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগে আছে। একবার বঙ্গবন্ধু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কলকাতার ব্যারাকপুরে এক সভায় গেলেন। সেখানে মহাত্মা গান্ধী, মনু গান্ধী, আভা গান্ধী তাঁর সেক্রেটারি ও অনেক কংগ্রেস নেতা গেলেন। সভায় জড়ো হয়েছে হাজার হাজার লোক। সেদিন ছিল রোববার, মহাত্মা গান্ধী রোববারে কথা বলেন না। মনু গান্ধী তাঁর লিখিত বক্তব্য পড়লেন। এর দুই দিন পরই ঈদ ছিল। ঈদের নামাজ পড়বে কি পড়বে না, মুসলমানেরা সেই ভয়ে ছিল। মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করলেন, হিন্দু–মুসলমান ভাই ভাই। কোনো গন্ডগোল হলে তিনি অনশন করবেন। তখন মহল্লায় মহল্লায় স্লোগান হলো, ‘মুসলমানকে মাত করো। বাপুজি অনশন করেগা।’ ঈদের দিন ভালো কাটল। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর এক সঙ্গী ইয়াকুব ঠিক করলেন, মহাত্মা গান্ধীকে কিছু উপহার দেবেন। সে সময় সারা কলকাতা ও বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, শিশুদের মাথা কাটা, মেয়েদের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত, বস্তি, মসজিদে আগুন জ্বলছে—এমন সব ছবি কলকাতার নারকেল ডাঙ্গায় গিয়ে তাঁকে দিলেন। এসব ছবি তাঁকে হয়তো ভীষণ আহত করেছিল।
চলবে...