ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-বঙ্গবন্ধু এবং অতঃপর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

চল্লিশের দশক থেকেই ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ ছিল। আবার তারাও এটা নিয়ে ভাবছিল। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা ‘মিশন’ এসেছিল। কিন্তু সে আলোচনা ব্যর্থ হয়। যুদ্ধের পর এসেছিল ক্যাবিনেট মিশন। এ মিশনের আলোচনায় কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এটা মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মনে হলো ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা দিতে পারলে বাঁচে। মুসলিম লীগও থেমে থাকেনি।

১৯৪৬ সাল, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বোম্বে (এখন মুম্বাই) এক কাউন্সিল সভা ডাকলেন। এটা হলো অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল। ১৬ আগস্টকে এই কাউন্সিল সভায় জিন্নাহ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি একটি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। সেটা হলো ভারতবর্ষের ১০ কোটি মুসলমান পাকিস্তানের দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর। কোনো বাধাই তারা মানবে না। এদিকে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা সব জায়গায় প্রচার করল, এটা তাদের বিরুদ্ধে। আবুল হাশিম কর্মীদের বললেন, দিনটা ভালোভাবে পালন করতে হবে। এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি; হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়। বঙ্গবন্ধুসহ সবাই এটা মহল্লায় মহল্লায় প্রচার করলেন। হিন্দু-মুসলমান সবাই যেন এক হয়ে দিনটি পালন করে। কিন্তু কংগ্রেস ও মহাসভার কাছে এই দাবি টিকল না। তারা বুঝিয়ে দিল, এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।

ইসলামিয়া কলেজের পাশে সরেন ব্যানার্জি রোড, ধর্মতলা, ওয়েলিংটন স্কয়ার—সব জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়। তারা কলেজের দিকে এগিয়ে আসছে। এখানে একটি মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। একজন মৌলভি জীবন বাঁচাতে ছুটে আসছেন কলেজের দিকে। লাঠি-তলোয়ার নিয়ে তাঁর পেছনে আক্রমণকারীরা। চারদিকে দাঙ্গা শুরু হয়েছে গেছে। পুলিশ কাঁদনে গ্যাসের শেল ছুড়ছে। বঙ্গবন্ধুরা চলে গেলেন গড়ের মাঠে।কালিরঘাট, হ্যারিসন রোড, ভবানীপুর, বড়বাজারসহ প্রায় সব জায়গার শোভাযাত্রায় আক্রমণ হয়েছে। তারপরও লাখ লাখ লোক সভায় জড় হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু অনেক মুসলমানের বাড়ি হিন্দুদের সঙ্গে লাগোয়া। তাদের খুব বিপদ হলো। বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রনেতা নুরুদ্দিন সবাইকে সাহায্য করার চেষ্টা করলেন।
বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় ৫০ জন ধর্মতলার মোড়ে গেলেন। দোকানপাট বন্ধ। করাও খাবার ব্যবস্থা নেই। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীর কাছে গেলেন। সে সময় ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহর ছোট ভাই নবাবজাদা নসরুল্লাহ কলকাতায় ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন সবাইকে চাল দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু ও নুরুদ্দিন সেখানে গেলেন। আশপাশের লোকজনকে চাল দিলেন। তবে দাঙ্গায় একটি বিষয় দেখা গেছে, সেটা হলো হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একে অপরকে বাঁচিয়েছে। কারফিউ দেওয়া হলো। কোনো কথা নেই, দেখামাত্র গুলি। অনেক সময় জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগের প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন ইংরেজ গভর্নর। সোহরাওয়ার্দী সরকার থেকে পদত্যাগের হুমকি দিলেন। গভর্নর রাজি হলেন। এদিকে কলকাতার পরই নোয়াখালী, বিহার, পাটনা, আসানসোলে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, নুরুদ্দিন তাঁদের দল নিয়ে এসব এলাকায় সাহায্যের জন্য চলে গেলেন। বিশেষ করে বিহারে চরম দাঙ্গা। পরিকল্পনা করে মুসলমানদের আক্রমণ করা হয়েছে। ব্যাপক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ঘরবাড়ি দখল, লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও, সে এক ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বিহারের রাজধানী পাটনায় সাহায্যের জন্য যান। বঙ্গবন্ধুও অনেক স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে পাটনায় গেলেন। সোহরাওয়ার্দীর কথামতো পাটনা থেকে হাজার হাজার শরণার্থীকে আসানসোলে আনা ও তাদের থাকা-খাওয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শরণার্থীদের জন্য অনেক দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর। এখানে প্রায় দেড় মাস কাজ করলেন। তারপর ভীষণ জ্বর নিয়ে কলকাতার বেকার হোস্টেলে ফিরলেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রায় ১৫ দিন হাসপাতালে ছিলেন।

এদিকে বিএ পরীক্ষার সব প্রস্তুতি শেষ। বঙ্গবন্ধু কিছুই জানেন না। তিনি পাকিস্তান, দাঙ্গা, শরণার্থী—এসব নিয়ে ব্যস্ত। তখন বেকার কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন জুবেরি আহমেদ। তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতির জন্য অনুরোধ করলেন। তিনি খুব ভালো করে জানতেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জন্য লড়ছেন। তিনি যেন বইপুস্তক নিয়ে কলকাতার বাইরে যান এবং ঠিকমতো পড়ে পরীক্ষার আগে এসে পরীক্ষা দেন—এই শর্তে অনুমতি দিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা অনুসরণ করে বিএ পাস করেন। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল কেন্দ্রে ওয়েভেল সরকার কিংবা রাজ্যে লীগ সরকার—কেউই এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে তেমন কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। চলবে...