অথচ পাকিস্তানি ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের জ্ঞানপাপীরা ধোঁকা দিতে চেষ্টা করল যে উর্দু ইসলামিক ভাষা। তাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু সে চেষ্টা তাদের সফল হয়নি। যেকোনো জাতি তাদের মায়ের ভাষাকে ভালোবাসে। কেউ এ ভাষার অপমান সহ্য করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তারা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহকে ব্যবহার করেও ব্যর্থ হলো।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। মুসলিম লীগ চাইল, জিন্নাহ যেন বলেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তখন ঘোড়া দৌড়াত। একে ঘোড়দৌড়ের মাঠ বলা হতো। ইংরেজি নাম হলো রেসকোর্স ময়দান। এই ময়দানে বিশাল জনসভা ডাকা হলো। জনসভায় জিন্নাহ বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বঙ্গবন্ধু প্রায় ৫০০ ছাত্র নিয়ে সেই সভায় ছিলেন। তাঁর সবাই চিৎকার করে জানিয়ে দিলেন, ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মানি না।’
তারপর কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দানের সময় মুহম্মদ আলী জিন্নাহ আবার সেই একই কথা জোর দিয়ে ঘোষণা করলেন। এবার বঙ্গবন্ধু আবদুল মতিনসহ হলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ‘না, না’ ধ্বনিতে চিৎকার করে উঠলেন। জিন্নাহর কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে গেল। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে এত মানুষ তাঁর মুখের ওপর ‘না, না’ করবে। আর পুরো বিষয়টা পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
এসবই বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। জিন্নাহর সামনে ‘না, না’ বলার পর তিনি প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে বসে ছিলেন। সম্ভবত তিনি এটা কল্পনাও করতে পারেননি যে তাঁর মুখের ওপর বাংলার ছাত্ররা ‘না’ বলবেন। জিন্নাহ যত দিন বেঁচে ছিলেন, আর কোনো দিন বলেননি, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
জিন্নাহ চলে গেলেন। তারপর ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হলো। সে সভায় এক ছাত্র বললেন, ‘জিন্নাহ যা বলবেন, তা–ই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন, তখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে।’ তখন সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাঁকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যা–ই হোক না কেন। আমরা প্রস্তুত আছি।’
একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে এক দিনে তিনি বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা হননি। ধীরে ধীরে সময়কে পেছনে ফেলে অনেক সংকটময় পথ অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন, পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রাজনীতি, ’৬৬ সালের ৬ দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তিনি ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বায়ান্ন সালে জেলে থেকেই তিনি ভাষা আন্দোলনের নির্দেশনা দিয়েছেন। কোনো সন্দেহ নেই যে ভাষা আন্দোলনে তিনি সামনের সারির অন্যতম নেতা ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদন; আবদুস সামাদ আজাদ, অলি আহাদ, গাজীউল হকসহ অনেক ছাত্রনেতা ও ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিচারণ, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও দলিলপত্রে।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির শর্ত যুক্ত থাকাই প্রমাণ করে যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দেশভাগের যেমন সূচনা পর্ব থেকেই তিনি বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছেন, তেমনি পরবর্তীকালে আইনসভার সদস্য ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন।
চলবে...