চাকরির পরীক্ষায় প্রবেশসীমা ৩২ করা সময়ের দাবি

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩২ করার দাবিতে মানববন্ধন করেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা
ছবি: বিজ্ঞপ্তি

করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সবকিছু থমকে গেছে। পালাক্রমে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আগের মতো কোনো রূপ নেই। পৃথিবীর সবকিছু রয়েছে নিস্তব্ধ, অচলাবস্থায়। বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এখনো বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বিপর্যস্ত। ঠিক তেমনি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে চাকরিপ্রত্যাশীদেরও বাজে অবস্থা। এ করোনা নামের ভাইরাসের ভয়াল থাবায় কত স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। করোনায় শিক্ষার্থীদের প্রায় ২ বছর সময় জীবন থেকে নষ্ট হতে চলেছে। করোনার এই সময়ে অনেকের চাকরির আবেদনের বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে। আবার অনেকেরই কাছাকাছি বয়স। এমন পরিস্থিতিতে চাকরিপ্রত্যাশীদের যেন প্রতিমুহূর্তে দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে। একদিকে যেমন করোনাভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তা, আবার অন্যদিকে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষ হওয়ায় দুশ্চিন্তা।

দেশে বর্তমানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে যখন গড় আয়ু ছিল ৫৫ বছর, তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ আর অবসরের ৫৭ বছর। এরপর সেশনজটের পরিস্থিতি বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২৭–এর পরিবর্তে করা হলো ৩০ বছর। আর তখন ১৯৯১ সালে গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। এরপর ২০১১ সালে এসে অবসরের বয়স বেড়ে হয় ৫৯ আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয় ৬০। অবসরের এই ২-৩ বছর বাড়ার কারণে এ সময় তেমন চাকরির বিজ্ঞপ্তিও হয়নি। ১৯৯১ থেকে ২০২১, ৩০ বছরে গড় আয়ু ১৬ বছর বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়েনি। ঠিক আগের অবস্থানে বহাল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করা যায়। আর সেটি হচ্ছে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কারণ, চিকিৎসকদের শিক্ষাজীবন বেশি দিনের হওয়ার কারণে তাঁদের আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর করা হয়েছে। কোটায় আওতাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্যও চাকরির বয়সসীমাও ৩২ বছর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সম্মান কোর্স তিন বছরের স্থলে চার বছর করা হলেও চাকরিতে আবেদনের প্রবেশকাল বৃদ্ধি করা হয়নি। তাহলে কি এমন পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা বৈষম্যের শিকার বলতে পারি না? প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক লেখাপড়ার সঙ্গে চাকরির প্রস্তুতিমূলক লেখাপড়ার কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আমরা যদি একটু পর্যালোচনা করে বলি, তাহলে দেখা যাবে, ইতিহাস বিভাগ থেকে পাস করে ব্যাংক কর্মকর্তা, আবার প্রকৌশলী হয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হচ্ছেন অনেকেই। চাকরির প্রস্তুতির জন্য যে লেখাপড়া করতে হয়, তার জন্য অবশ্যই আলাদা করে প্রস্তুতিমূলক সময়ের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে করেন, তাহলে তিনি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো সময়ই পান না। তাহলে এসব বিষয় বিবেচনা করে চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না, সেটাও প্রশ্ন।

দেশে এমনিতেও বেকারত্বের হার অনেক বেশি। একটি দেশের জন্য বেকারত্ব হচ্ছে হুমকিস্বরূপ বা অভিশাপ। কারণ, এ বেকারত্ব দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বা সার্বিক উন্নয়নের পথে ধাবিত হওয়ার জন্য বড় একটি বাধা। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে অবিরত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে এ হার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষিতদের মধ্যে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যমতে, গত আট বছরে তরুণ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, শতকরা হিসাবে যা ১৩ শতাংশ। আর উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে বেকার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ কিন্তু কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ। অর্থাৎ বেকার ২৭ লাখের বেশি, যার মধ্যে শিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যাই বেশি। আর শিক্ষিত বেকার হওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়া।

আমরা যদি অন্যান্য দেশের চাকরির প্রবেশের বয়সসীমা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের চাকরির বয়সসীমা ৩০ বছরের চেয়ে তাদের প্রবেশসীমা ওপরে। বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৫৫টি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৫৫ বছর। আবার কোথাও কোথাও ৫৯ বছর পর্যন্ত। পৃথিবীর যত উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্র বা দেশে চাকরির বয়সসীমা ত্রিশোর্ধ্ব হওয়ার কারণেই তারা এত উন্নত। তাহলে অন্যান্য দেশের চেয়ে আমরা কেন চাকরির বয়সসীমার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকব? আমাদের দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০–এর ঊর্ধ্বে করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনসহ চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না, বরং শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। তাই চাকরিপ্রত্যাশীদের দাবি, করোনাকালে সরকারের সব প্রণোদনার পাশাপাশি মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে আমরা বেকার যুবকেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘প্রণোদনাস্বরূপ’ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩২ বছর করার জন্য দাবি জানাই।

সুতরাং আমরা চাই, কেবল করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীদের কথা না ভেবে, বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি যেন বৈষম্যহীন ও সর্বজনীন হয়। বেকারত্ব হ্রাস করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাকরির প্রবেশের বয়সসীমার দিকটি বিবেচনা করে বাংলাদেশেও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো উচিত। এতে চাকরিপ্রত্যাশীরা নিজ কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়ার ফলে দেশ উন্নতির শিখরে দুর্বার গতিতে পৌঁছাতে পারবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। নয়তো শিক্ষার মান উন্নয়নের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়বে। তাই জাতীয় স্বার্থে, বেকারমুক্ত দেশ গড়তে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধাকে মূল্যায়ন করতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

*লেখক: মু. সায়েম আহমাদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা