৫০ বছর ধরে ভিক্ষায় জীবন চলে ফুলবাসির
প্রকৃতিতে ফাল্গুনের শেষ প্রায়, চৈত্রের আগমনী বার্তায় গ্রামের মেঠো পথ তপ্ত রোদে খাঁ খাঁ করছে। ফসলের মাঠে বোরো ধানের বুকফাটা জমিনের চারা গাছের শিকড়ে শিকড়ে চুইয়ে যাচ্ছে গভীর নলকূপের টলটলে পানি। আকণ্ঠ তৃষ্ণা মিটিয়ে মৃদুল হাওয়ায় দুলছে ধানের চারাগুলো, এই দেখে খেতের আলের পাশে বিড়বিড় করে কী যেন কথা–বলাবলি করেন কৃষক তাঁর শস্যের উদ্দেশে। এরই মধ্যে কহর পড়া (চলতে চলতে পায়ের তলায় শক্ত হয়ে যাওয়া) পা দুটি ক্লান্ত, হেঁটে যান বিরামহীন উত্তপ্ত ধূলিমাখা পথ ধরে, গ্রামের পর গ্রাম। যেন হাপরের মতো বুক চিরে দমটা তাঁর বেরিয়ে যায় এখনি। এবার শাখায় নতুন আম্রমুকুলের ভারে নুয়ে পড়া একটা আমগাছের নিচে এসে তিনি দাঁড়ালেন। রোজ দাঁড়ান তিনি। এ গাছটা জানে একটা যৌবন কাঠখড়িতে পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার নিদারুণ করুণ গল্পটা। মাথায় পুরোনো একটা ছেঁড়া শাড়ির পোঁটলা, অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে যাওয়া হৃৎপিণ্ডটায় একবুক নিশ্বাস নিতে নিতে আবার মুহূর্তেই পড়ে যান, আবার কখন তাঁর প্রশ্বাস ঠাহর পান না তিনি। বুকে যেন তাঁর আজ কতগুলো বছর অবিরাম কয়লার ইঞ্জিনের মতো রেলগাড়ি ছুটে চলে, শাড়ির আঁচলে কপালের ঘামটা মুছে আবার হেঁটে চলেন সরাতিয়া গ্রামের মুচার বাড়ির রাম জতন রবিদাসের বউ ফুলবাসি রবিদাস, গ্রামের মানুষ যাকে ডাকে রামু মুচারের বউ বলে।
আদতে বাসি ফুলে মালা গাঁথা হয় না, হয় না পূজার আরাধনাও; তবু যে তিনি ফুলবাসি। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা ফুলবাসি গ্রামের পথে পথে ভিক্ষা করে সংসার চালান।
বলছিলাম ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের সরাতিয়া গ্রামের রাম জতন রবিদাসের স্ত্রী ফুলবাসি রবিদাসের কথা। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ডাকাতিয়া গ্রাম থেকে বউ হয়ে ফুলবাড়িয়ার সরাতিয়া গ্রামে আসেন ফুলবাসি রবিদাস। সংসারে পাঁচ বোন থাকায় অনেকটাই বোঝা হয়ে যান ফুলবাসি, তাই গোত্রের প্রথা অনুযায়ী রীতিনীতি মেনেই বিয়ে হয় পাশের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাম জতন রবিদাসের সঙ্গে। পেশায় রাম জতন সুয়ারি (পালকি বয়ে নিতেন) খেপাতেন। রাম জতনের ঘরে বউ হয়ে আসার পর শুরু হলো স্বাধীনতাযুদ্ধ, এদিকে জীবনযুদ্ধও চলতে থাকল ফুলবাসির। খেয়ে না খেয়ে, পালিয়ে বেড়িয়ে, স্বাধীনতার সময়টা পার করলেও কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েন স্বাধীনতার পর। কঠিন অসুখে পড়ে গেলেন স্বামী রাম জতন, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলেন না, কাঁধে তুলতে পারলেন না গ্রামের নববধূর পালকি। তাই সংসারের সমস্ত বোঝা কাঁধে এসে পড়ল ফুলবাসির।
কিছুদিন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করলেও জাতকুলে মোচার বলে তাঁকে কাজ দেয়নি গ্রামের রক্ষণশীল গেরস্ত পরিবারগুলো। তাই জীবন বাঁচাতে, জীবিকার তাগিদে, ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নেন ফুলবাসি রবিদাস।
প্রায় বছর পাঁচ আগে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে স্ট্রোক করে মারা যান চার সন্তানের জনক ফুলবাসির দুই ছেলে গণেশ ও দুলাল রবিদাস। মৃত্যুর সময় তাঁরা পরিবারে রেখে যান তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের। বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে কমল রবিদাস, পেশায় নাপিতের কাজ করলেও বেশ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকায় বর্তমানে পরিবারটির ১২ সদস্যের ভরণপোষণের খরচসহ স্বামী-সন্তানের চিকিৎসার খরচ বহন করতে হচ্ছে বৃদ্ধ মায়ের ভিক্ষা করা পয়সায়।
একটি পলিথিনের ছাউনির ঘরে ১২ সদস্যের পরিবার কোনোমতে নামমাত্র দিনাতিপাত করে বেঁচে আছে। একটু দমকা হাওয়া, বাতাস কিংবা ঝড়ের আভাস পেলেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয়ের আশায় ছুটে যান পাশেই সরাতিয়া নতুন বাজারের কোনো দোকানে।
উপজেলার সরাতিয়া নতুন বাজার এলাকায় ফুলবাসির পরিবারের কাছে গিয়ে দেখা যায়, অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন পরিবারের সদস্যরা। ঘরে খাবার নেই, বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে সময় পার করছেন উঠোনে বসে থাকা পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ রাম জতন রবিদাস। কিছুদিন টাকাপয়সা খরচ করে চিকিৎসা করাতে পারলেও এখন আর চিকিৎসা করাতে পারছেন না রাম জতনের, যেখানে ভাত খেতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে তাঁর পরিবারের মানুষগুলো ওষুধ কিংবা চিকিৎসার খরচ কোথায় পাবেন? এদিকে বেঁচে থাকার একমাত্র ছেলে কমল রবিদাস নাপিতের কাজ করে যে কটা টাকা উপার্জন করেছিলেন, তা–ও চিকিৎসার ব্যয়ে শেষ। পরিবারটি এখন সর্বস্বান্ত। পলিথিনের ছাউনির ঘরে জড়সড় হয়ে কোনোমতে বসবাস করছে ফুলবাসীর পরিবার। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি পাশ্ব৴বর্তী শিবগঞ্জ, বৈলাজান, ধামর, বাক্তা, শ্রীপুর, বড়খিলা গ্রাম ঘুরে ভিক্ষা করে যা পান, তা দিয়েই বেঁচে আছে পরিবারটি। ফুলবাসির পরিবারের অভিযোগ, বিগত দিনগুলোতে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ডসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বহুবার সরকারি সহযোগিতা চাইলেও পোড়া কপালে তাঁদের আদৌ জোটেনি কিছুই।
নিজের অভাব–অনটন আর দুঃখ–কষ্টের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ওঠেন ফুলবাসি রবিদাস। তিনি বলেন, ‘জীবনে আপনি কি কখনো হুনছেন একটা মেয়েমানুষ ৫০ বছর ধইরা ভিক্ষা করে? দুইটা পোলা মইরা গেছে আমার বছর না ঘুরতেই। নিজের পোলা মরার পর শেষকৃত্যের লাইগা এই ফুলবাসি মানুষের কাছে দুই টেকা ভিক্ষা করছে। ভগবান আমার কপালটাই এমন কইরাই বানাইছে, বাবা। সংসারে ১২ জন মানুষের খাওন জোগানো লাগে আমার। আমার একটা ঘর নাই, ঝড়–তুফান আইলে বাজারে গিয়ে আশ্রয় নেওন লাগে। গেরামের মেম্বার–চেয়ারম্যানের কাছে একটা ঘরের লাইগা কত কথা কইলাম, একটা বয়স্ক ভাতার কার্ডের লাইগা কত চাইছি, কেউ দেয় নাই। সবাই খালি আশা দিছে। এরা কেউ কোনো দিন চিন্তা করে নাই যে ফুলবাসি কেমনে বাঁইচা আছে। জাতে মুচার বইলা সারা জীবন মাইনষে দূর দূর করছে। তাই জীবনের শেষ ইচ্ছা, আমি তো মইরাই যামু, অন্তত পোলাপানগুলার লাইগা আর একটা ঘর চাই সরকারের কাছে।’
*লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ