হিসাবটা বন্ধুত্বের

যৌবন রঙিন, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ছাত্রজীবন। বন্ধুদের সঙ্গে হাত বাড়ালেই আনুষঙ্গিক সবই পাওয়া যায়। ভাগ্য কিংবা আর্থিক ব্যাপার যদিও তর্কসাপেক্ষ। রঙিন আলোচনায় তর্ক একপাশে তোলা থাক, তাতে রঙের ছোঁয়ায় আলোচনা বেশ সুবিধার হবে। বন্ধুরা বরাবরই এক পা এগিয়ে থাকে যেকোনো আড্ডা জমাতে কিংবা রাঙাতে।

ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট—এত কিছুর ভিড়ে ছুটির দিনগুলোতে এক চিলতে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারা যায় বন্ধুদের কল্যাণে। হাসির রোল বইয়ে দেওয়া মজার কথা কিংবা মন খারাপ করার মতো কোনো ব্যাপার—সবই থাকে আলোচনায়। এই হাসি, তো এই মন খারাপ। তাতেই আড্ডা পূর্ণতা পায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রায় ১৭৫ একর জায়গাজুড়ে। পুরো ক্যাম্পাসে একটা চক্কর দিলে প্রকৃতির পুরো স্বাদ নেওয়া হয়ে যায়। তবুও বাইরে কোথাও, একেবারে গ্রামে, গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়াটা দারুণ!
- মঈনুল, চল ত্রিবেণী বাজারে যাব।
- আচ্ছা।
- রেডি হ। অন্যদেরও বলেছি।

বিকেল পাঁচটার আশপাশ, ফোনকলের ওই প্রান্তে মুকিত। আমাদের বন্ধুমহলে আবেগী ছেলে বলে তার সুনাম খুব। দারুণ আমুদে। সবাইকে মাতিয়ে রাখতে তার সেকি প্রচেষ্টা বরাবরের! তার সঙ্গে একবাক্যে রাজি না হয়ে উপায় নেই। যথারীতি তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রস্তুত হয়ে বের হব বলে ভাবছি—অমনি সে এবং ‘নিবিড়’ মেসের রুমে এসে হাজির। আরেকটা আমুদে চরিত্র, ফাঁপর নিতে যার জুড়ি মেলা ভার। একসঙ্গে বের হলাম তিনজন। কিন্তু আমরা তিনজনই ছিলাম না। সে বন্ধুমহলের অন্য সবাইকেও বলেছে। তাই বাকিদের অপেক্ষা এবার। শাওন, মন, সবুজ, নিশাত, রকিব—এই তো আমরা একসঙ্গে কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে। সবাই বন্ধুমহলের বিশিষ্ট নাম, সবারই অনেক গুণ। সেসব লিখলে বই হয়ে যাবে।

ইংরেজি বিভাগে প্রথম ক্লাস থেকেই আমরা একে অপরকে চিনি এবং জানি। আমাদের সবকিছুই রঙিন স্বপ্নের মতো এগিয়ে চলছিল। করোনাভাইরাস এসে সবকিছুতেই বাগড়া দিল। তবুও যোগাযোগ, বন্ধন ফিকে হয়ে যায়নি। তবে রীতিমতো উড়তে থাকা আমাদেরকে রীতিমতো মাটিতে নামিয়েছে। মোটামুটি সবাই-ই কঠিন সময় পাড় করছি পারিপার্শ্বিক নানান কারণে। সবাই একসঙ্গে হয়ে গেলে কিঞ্চিৎ মুক্তি মেলে, সেসব ভাবনা–চিন্তা হতে। এই যে আমরা অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি, সেটার পুরো আনন্দ লিখে কিংবা বলেও বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে সেই আনন্দ স্মৃতির পটে ভেসে উঠবে নিশ্চিতভাবেই। যখন সবাই চাইলেই এভাবে একবাক্যে রাজি হয়ে কোথাও ঘুরতে কিংবা আড্ডায় শামিল হতে পারব না।

কোথাও যাওয়ার কিংবা খাবার আবদারে প্রায়ই এক হয়ে যাই আমরা। ত্রিবেণী বাজারে হেঁটেই যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। যাওয়ার পথে মন বেশ কয়েকবার বলেছে সে গরম মিষ্টি খাবে। ছেলেটা যদিও একটা মিষ্টি খেয়েই তৃপ্তির ঢেকুর তোলে, তবু সে বারবার গরম মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারটা মুখ্য রাখতে চেষ্টা করেছে। মনকে জিজ্ঞাসা করা হলো, শুধু মিষ্টিই খাবি? উত্তরটা শাওন দিয়েছে, ‘মুড়ি মাখাব সেদিনের মতো করে।’ আর নিশাতের আবদার, ‘তাহলে মঈনুল, আমাদের নিয়ে পত্রিকায় লিখবি তুই।’ রকিবের সায়, ‘হ লিখতে হইব।’ সবুজ ছবি তুলতে ফোন এগিয়ে দিয়েছে। সবাই নানান গল্প করতে করতে পা চালিয়েছি। এভাবে ফুর্তি করতে করতে ত্রিবেণী বাজারে পৌঁছে যাই সন্ধ্যা নাগাদ।

আমরা ভাজাপোড়ার ঝুপড়ি দোকানের মাঝখানে টেবিল টেনে দুই পাশে বসি। বন্ধুদের আড্ডায় খাবার কেনার টাকা একসঙ্গে করাটা মজার। সেটা নিয়েই মুহূর্তে আলোচনা শুরু হয়। বেশ ভালো একটা পরিমাণ একাট্টা হলে ওরা বললো, এখান থেকে মিষ্টির টাকাটা আলাদা কর। এরপর বললো,
-তুই টাকা দিবি না?
-হ্যাঁ, দেব।
-তাহলে দেখ আর কত লাগে? সেটা তুই খরচ করবি।

মুখ গোমড়া করে নিমরাজি আমি আর শাওন মুড়ি, চানাচুর, ম্যাগি মশলার প্যাকেট কিনতে বেরিয়েছি। আর ভাজাপোড়ার দোকানে ছোলা ভুনা আর পেঁয়াজি, পেঁয়াজ, মরিচ সমেত সালাদ পাওয়া যাবে। তাতেই বেশ ভালো একটা মুড়ি মাখানো হয়ে যায়। দোকানদার মামা আমাদেরকে একটা বিশাল থালা দিয়েছেন মুড়ি মাখানোর সুবিধার্থে। তাতেই মুড়ি মাখানো হলো। বেশ প্রতিযোগিতা করে মুড়ি মাখানো খেয়ে তৃপ্ত সবাই। গন্তব্য এবার গরম মিষ্টির বাড়ির পানে। বাঁশঝাড়ের নিচে মন্দিরের পাশে বাড়িটা। মিষ্টি বানানোর কাজে মহিলা ও পুরুষ উভয়েই ব্যস্ত। আমরা এক কেজি গরম মিষ্টির ফরমাশ দিয়ে অপেক্ষা করছি। আর কে কয়টা খেতে পারব, সেটা বলছি। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছি একে অপরের প্রতি। কিন্তু বাসনভর্তি গরম মিষ্টি আসতেই সবাই মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এক কেজি মিষ্টিতে যেখানে প্রায় গোটা সতেরো কি আঠারো পিস মিষ্টি আটজনে খাচ্ছি। তবুও কেউ চারটে কেউ তিনটে মিষ্টিও সাবাড় করেছি।

বন্ধুত্বের ভাবনাগুলো অদ্ভুত সুন্দর। গোটা চারেক মিষ্টি খাওয়া বন্ধুটির প্রতি কেবল একটি খেতে পারা বন্ধুর কোনো অভিযোগ নেই। মুড়ি মাখানো কিংবা মিষ্টি খাওয়ার সময় যে আনন্দ নিয়ে খেয়েছি, সেটি দুর্মূল্য। বা কে কত খরচ করল, সেটিও হিসাবযোগ্য নয়। হিসাবটা আনন্দের, বন্ধুত্বের। এটিই বড় ব্যাপার। বন্ধুত্ব হোক প্রাণের। দুঃখের সময়ে সাহস হওয়ার, একে অপরের প্রতি নিবেদিত থাকার।
লেখক: মঈনুল হক খান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।