হাঁটুতে ভর করে চলছে জীবনের নিরানন্দ গল্পটা
‘আমরা পাঁচ বোইন, কোনো ভাই নাই। আমি আর সুফিয়া বু—দুই বোইন জন্ম থিকাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় মা মইরা যায়, তারপর বড় বোইনেরা আমারে কোলে–পিঠে কইরা মানুষ করছে। জন্মের পর থেইকাই অচল জীবন আমার, প্রতিবন্ধী মানুষ আমি, তবু আব্বা আমারে গ্রামের মাদ্রাসায় ভর্তি কইরা দিল। খুব ইচ্ছা ছিল, লেখাপড়া কইরা সরকারি স্কুলের মাস্টার হমু। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আব্বায় মইরা গেল গা। দুনিয়াত আর আপন বইলা কেউ রইল না আমার। জায়গা নাই, জমি নাই—আমগর বাপ বাঁইচা থাকতেই সব বেইচা খাইয়া গেছে গা। জমির মালিকেরে ভিটা বুঝায়া বিদায় হইলাম; বোইনরাও যে যার মতো কাজে চইলা গেল গা দেশে দেশে। আমি আর কী করমু? আমার মতো একটা অচল মানুষেরে কে কাজ দিব! তারপর আল্লাহর নাম লইয়া চইলা গেলাম ঢাকায়। পোশাক কারখানায় একটা চাকরির লাইগা গেইটের সামনে যাইয়া দাঁড়াইয়া থাকতাম। আমারে দেইখাই দারোয়ান তাড়ায়া দেয়, শেষ পর্যন্ত ভাবছিলাম, এই দুনিয়ায় আমার জন্য অন্তত কোনো কাম নাই। কিন্তু হঠাৎ একটা গার্মেন্টসের মালিক আমারে দেইখা দয়া করলেন, আমারে একটা চাকরি দিলেন। আমি সেখানে শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করলাম। ১৫ বছর এই অচল শরীর লইয়া পাঁচ তলার সিঁড়ি বাইয়া উপরে উইঠা কাম করতে খুব কষ্ট হইতো। তারপরও চাকরি করছি। এমদাদুল নামের এক রাজমিস্ত্রির সাথে বিয়া হয়। দেখতে দেখতে তিনটা সন্তানের মা হই, তারপর থিকাই সংসারটা তিতা হয়া যায় আমার। অসুস্থতার কারণে চাকরিটা ছাইড়া দিই, এই হাঁটুতে ভর কইরা পাঁচতলায় উঠানামা করতে পারতাছিলাম না আর কোনোভাবে। শেষে চাকরিটা বাধ্য হয়া ছাইড়া দিতে হইলো। শেষে ফিরা আসি গ্রামে, কিন্তু গ্রামে কোথায় যামু, মাথা গোঁজার মতো কোনো ঠাঁইতো নাই, কিছুই নাই। চাকরি কইরা যা জমাইছিলাম, সব স্বামী জুয়া খেইলা উড়াইয়া দিছে। শেষমেশ আমার এক ভাগিনার পুরাতন ভিটায় কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হইলো। অন্যের দেওয়া ছাপড়ি ঘরে কোনোমতে স্বামী, তিন সন্তান,আর প্রতিবন্ধী বড় বোইন সুফিয়ারে নিয়া থাকি। আরেকজনের কলের পানি খাই, যেকোনো সময় ভাগিনা আইসা লাথি দিয়া খেদাই দিলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরা লাগব। পোলাপান লইয়া না থাকার মতো বাঁইচা থাকতে হয়। যত দিন চাকরি করছি, বেতন পাইয়া মাসের পুরা টাকা স্বামীর হাতে তুইলা দিছি আমি। আইজ পাঁচ বছর যাবৎ গেরামে আছি। এহন তো চাকরি করতে পারি না, তাই স্বামীর কাছেও তিতা হয়া গেছি আমি। সুযোগ পাইলেই আমার স্বামী ইবরাহিম মারধর করে, আরেকটা বিয়া করার হুমকি দেয়। আমার মতো অচল মানুষের খবর কেউ লয় না মিয়া ভাই। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা আমি পাই না। কী খায়া থাকলাম, কেমনে আছি কেউ খবর নেয় না, কোরনায় স্বামীর কাম বন্ধ হওনে ঘরে খাওনদাওনও নাই, ঈদে পোলাপানগুলাইনরে একটা নতুন কাপড় কিনা দিতে পারমু না। জীবনে খুব বেশি একটা স্বপ্ন ছিল না আমার, খালি মাথা গোঁজার জন্য একটা ঘর চাই। পানি খাওয়ার জন্য একটা কল চাই, চক্ষুলজ্জায় ভিক্ষা চাইতে পারি না মানুষের কাছে!’
যে মানুষটি এতক্ষণ হৃদয়ের যন্ত্রণাগুলো উগরে দিচ্ছিলেন, তিনি আর কিছুই না; দুই হাঁটুতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা বিংশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের এক জীবন্ত উদাহরণ। রক্ত–মাংসের জীবনের অস্তিত্ব হয়তো এখনো তিনি বয়ে বেড়ান তাঁর শরীরে জীবনের নিয়মেই, আদতে জীবনের সব সুন্দর, মূল্যবান সময়গুলো পোশাক কারখানার নিরলস শ্রম আর পাঁচতলার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঠতে আর নামতেই ফুরিয়ে এসেছেন আসমা বেগম।
আসমাদের শরীরের রক্ত পানি করা শ্রমের বিনিময়ে আজ শহরে মালিক বাবুদের অট্টালিকাগুলো আকাশ ছুঁই ছুঁই। জীবনসংগ্রামের ক্রমাগত এ লড়াইয়ে টিকে থাকা আসমারা আদতে কেমন আছেন, আমরা কি কোনো দিন জানার চেষ্টা করেছি তা? জানতেও কি চাই আসলে? হয়তো না। কথিত শিল্পায়নের পুঁজিবাদের পৃথিবীতে যেখানে একজনকে মেরে আরেকজনকে উঠতে হয় ওপরে, সেখানে আসমার মতো প্রতিবন্ধী নারীরা বরাবরই সমাজের সবচেয়ে অবহেলা আর অবজ্ঞায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীরই একজন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে প্রায় পাঁচ বছর ধরে আরেকজনের আশ্রয়ের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে পরিবারটি। আসমাসহ পরিবারের ছয় সদস্য এখন বসবাস করছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নে মহিশের চালা গ্রামে।
গ্রামে ফিরে আসার পর স্বামী ইবরাহিম রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে সংসারটাকে কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে পারলেও গত এক বছরের করোনার মহামারির থাবায় সংসারটি আজ পথে বসার উপক্রম। বাইরে কাজ না থাকায় অনেকটা অর্ধাহারে-অনাহারে থাকছে পরিবারটি। আশ্রয়হীনতার আশঙ্কায় ভুগছে, যেকোনো সময় এসে তাদের আশ্রয় দেওয়া ভাগনে জায়গা খালি করার কথা বলতে পারেন।
অর্থ না থাকায় ঈদের আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয় পরিবারটির। অর্থের অভাবে ছোট ছেলে–মেয়েদের নতুন জামা–কাপড় দেওয়া আর ভালোমন্দ খাওয়ানো সম্ভব হয়নি পরিবারটির পক্ষে। ঢাকায় থাকা অবস্থায় আসমা একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করতে পারলেও স্থানান্তর জটিলতার কারণে ভাতার টাকাও আটকে আছে অনেক দিন যাবৎ। কর্মহীন হয়ে পড়ায় আসমার স্বামী ইবরাহিম তাঁকে প্রায় সময় মারধর করে তালাক দেওয়ার হুমকি দেন। ইচ্ছা ছিল ছেলে আশিক, মেয়ে ইয়াসমিন ও জুলেখাকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। যেখানে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে–পরে বাঁচতে পারে না পরিবারটি, সেখানে এমন স্বপ্ন যেন অধরাই থেকে যায় আসমার কাছে। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে বললে অবলীলায় তিনি জানান, আমার মতো অচল মানুষের জীবনে শুধু একটাই চাওয়া, একটা থাকার ঘর যদি কেউ করে দেয়।
আসমার ইচ্ছাটা পূর্ণতা পাক...।