স্মৃতিতে অম্লান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

এক ঢিলে দুই পাখি মারার অভ্যাস আমার সব সময়েরই। উচ্চশিক্ষার সিঁড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে সবাই যেমন একেকজন যোদ্ধা বেশে একেক রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে পাড়ি দিচ্ছে, আমিও তার অংশ হিসেবে পাড়ি দিয়েছিলাম রাজশাহী রণাঙ্গন তথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ভর্তিযুদ্ধের চেয়েও আমার কাছে মুখ্য ছিল রাজশাহীকে দেখা, রাজশাহীকে জানা। আমার এই জানা-দেখার তৃষ্ণা জীবনভর জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে থাকবে। নতুন কোনো কিছুকে জানার কৌতূহল আমার সে ছোটবেলা থেকেই।

ফেনীর মহিপাল থেকে রাতে রওনা দিয়ে ভোরে পা দিলাম রাজশাহীর মাটিতে। মাটিতে পা রাখতেই আমি পায়ে এক সভ্য শীতলতা অনুভব করি। বাস থেকে নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে। নেমে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিকে দৃষ্টি দিই। যেদিকেই তাকাই, সেদিকে তৃপ্তির ছায়া দেখতে পাই। রাস্তা পার হয়ে পাড়ি দিলাম রাবি ক্যাম্পাস আঙিনায়।

কিছুক্ষণ সামনের পথ ধরে হাঁটতেই ঘুমমাখা চোখে আস্ত এক আলোর ছায়া পড়ে। সে আলোর বিচ্ছুরণ হোয়াইট হাউস থেকে! সত্যিই কি সেটি হোয়াইট হাউস?
হ্যাঁ, আমার চোখে রাবির গা ঘেঁষে যে বৃহৎ প্রশাসনিক ভবনটা দাঁড়িয়ে আছে, ওটা হোয়াইট হাউসই মনে হয়েছে।

আরেকটু পথ হাঁটতে চোখে পড়ল বিখ্যাত ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ ভাস্কর্য। বাংলাদেশের বিসিএসসহ এমন কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেই, যেটাতে আসে না সাবাশ বাংলাদেশ ভাস্কর্য কোথায় অবস্থিত? এত দিন শুধু বই-পুস্তকেই পড়েছি, কিন্তু আজ চোখ মেলেই দেখতে পেরেছি।

আর কিছুক্ষণ হাঁটতে চোখে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব কোণ দখল করা বিখ্যাত গোল্ডেন জুবেলি টাওয়ার। এর একটু সামনেই রাবির কেন্দ্রীয় মসজিদ। প্রাচীন ও আধুনিক কারুকার্যখচিত এ মসজিদ যেকোনো সম্প্রদায়ের মানুষকেই আকৃষ্ট করবে। মসজিদের ঠিক বিপরীতে আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এর পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম সংগ্রহশালা, যেটা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর মুঠোফোনে কল দিলাম রাবিতে পড়া আমাদের ফেনীর রিয়াজ ভাইকে। সিনিয়র হলেও তাঁর সঙ্গে আমার খুবই অন্তরঙ্গতা। আসলে আমার সঙ্গে ক্ষণিকের মধ্যে ছোট-বড় সবারই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়ে যায়। তিনি কল রিসিভ করেই বললেন, ইমন! তোমরা কি চলে এসেছ?

আমি বললাম, জি ভাইয়া, চলে এসেছি।
তুমি এখন কোথায় আছ?
ক্যাম্পাসে, ভাইয়া।
আচ্ছা, তাহলে শোনো। ওখান থেকে রিকশা বা টমটমে ওঠে বলবা যে নর্ডান গেট নামব। আমি ওখানে আছি...

রিকশায় উঠলাম ক্যাম্পাস থেকে। রিকশাওয়ালার ব্যবহার আমাকে পুরো নির্বাক করে দিয়েছে। তিনি আমার সঙ্গে এমন কথা বলছেন, মনে হয় আমি তাঁর রক্তের কেউ, যুগ যুগ ধরে তিনি আমাকে চেনেন-জানেন। রিকশা থেকে নেমে রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর মেসে উঠলাম। সেখানে গিয়েও মেসের অন্য ভাইদের আতিথেয়তা, তাঁদের ব্যবহার আমাকে আরও মুগ্ধ করল, ভাবিয়ে তুলল।

আমার পরীক্ষা ছিল দুপুরের শিফটে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে সেখানকার শিক্ষকদের ব্যবহারও আরেকবার মুগ্ধ করল। পরীক্ষা শেষে দুপুরে খেতে এলাম মেসের পাশে ঘরোয়া একটা হোটেলে। সেখানে গিয়েও দেখি আরেক চমক! হোটেলের সেবার কাজে নিয়োজিত লোকজনের ব্যবহার, এমনকি হোটেলের মালিকের ব্যবহারও ছিল আমার কাছে নির্বাক হওয়ার মতো। খেয়েদেয়ে যখন বিল পরিশোধ করে বের হচ্ছি, তখন হোটেলের মালিক বললেন, ‘বাবা, তোমরা কোথা থেকে এসেছ?
বললাম, ফেনী।
পরীক্ষা কেমন দিলা?
হেসে হেসে বললাম, খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছি, আংকেল।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, চান্স হবে তো?
বললাম, জি আংকেল, হবে এবং খুব ভালো পজিশন আসবে আশা করি। দোয়া করবেন।

আমি দেশখ্যাত রাবির আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলাম।
ওই হোটেলমালিক আংকেল আবার জিজ্ঞেস করলেন, ফেনী যাওয়ার টিকিট কেটেছ? তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, বাবা, টিকিট না পেলে কোনো সমস্যা হলে আমাকে বোলো।

আমি বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে, আংকেল, কোনো সমস্যা হলে জানাব। ধন্যবাদ ও কুশল বিনিময় করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এ যেন সন্তানের প্রতি এক মহৎ পিতৃতুল্য আচরণের সাক্ষী হলাম।

হাঁটতে হাঁটতে মগজে শুধু একটা বিষয় খেলা করছিল, রাজশাহীর মানুষগুলো এত ভালো কেন? এত মহৎ কেন?

এরপর একটা দোকানে ঢুকলাম চা খেতে। চায়ের প্রতি আমার অসম্ভব তৃষ্ণা রয়েছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে দোকানির স্নেহাশিস আচরণ আমাকে পুরো থ বানিয়ে দিল।
মোটাদাগে রাজশাহীর প্রতিটা শ্রেণি-পেশার মানুষ, একজন রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে চা-দোকানদার পর্যন্ত মানুষগুলো আমার কাছে দেবতাতুল্য মনে হয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক বিভাগে ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। এ ক্ষুদ্র বয়সে আমার অনেক জায়গায় ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে আমার রাজশাহী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল পূর্ববর্তী সব ভ্রমণ থেকে ভিন্ন! আমার দেখা এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভদ্র, অমায়িক, সভ্য মানুষ হলো রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। এমনিতে এখানকার মানুষজন গালিগালাজ করলেও সেটা ভদ্র ভাষায় করে। এ জন্যই হয়তো রাজশাহীকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের শিক্ষানগরী।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েও ঠান্ডা মাথায় সুযোগ ছেড়ে দিয়েছি শুধু একটা চ্যালেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত করতে। সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত এবং আলোর মুখ দেখছে অবারিত। সে চ্যালেঞ্জ বুকে ধারণ না করলে আমি হয়তো আজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতাম। আইন বিভাগ ছেড়ে কেন ইংরেজি বিভাগ নিয়েছি, সেটা নিয়ে তখন অনেক তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো জানে না এর নেপথ্যে কী! সেদিনের সেই চ্যালেঞ্জই আমার আজকের অবস্থান তৈরির কারিগর। আমাকে সে চ্যালেঞ্জ নিতে যে সাহায্য করেছিল, সে হলো ঢাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহীর মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমার রয়েছে গভীর প্রেম ও মুগ্ধকর আলো ছড়ানো সব স্মৃতি। ৬৮তম গৌরবোজ্জ্বল জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। জয়তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: ইমরান ইমন, শিক্ষার্থী: ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়