স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রই সমস্যার সমাধান
ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের টানা কয়েক দিনের আক্রমণ বন্ধ হয়েছে। দুই দেশ সম্মতি দিয়েছে যুদ্ধবিরতিতে; গত শুক্রবার থেকে কার্যকর হওয়া এ যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে ১১ দিনের সহিংসতার সমাপ্তি হয়। কিন্তু গত রোববার ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। এদিনে ইসরায়েলের বিমান হামলায় প্রাণ গেছে আরও ৪২ ফিলিস্তিনির, যা গাজায় হামলা শুরুর পর এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। ফিলিস্তিনে কী ঘটছে এবং কী ঘটতে যাচ্ছে, তা অনুমান করে আমি হতবাক। ফিলিস্তিনে এসব হামলার ঘটনা কি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়? বিশ্বে এখন মানবিকতা কোথায়? ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে আছে। বিশ্বনেতারা কী করছে? এই সংকট মোকাবিলায় কেন কোনো ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। শুধু নিন্দা জানিয়ে এই অন্যায় হামলার স্বরূপ বোঝানো যাবে না। ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু যারা এই কাজ করবে বলে আমরা আশা করি, সেই পাশ্চাত্য দেশগুলোই তো এ হামলার পেছনে প্রচ্ছন্ন ইন্ধন জুগিয়ে চলছে!
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মুখে যুদ্ধবিরতির পক্ষে সমর্থন জানালেও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। এর আগে ১০ মে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং যুদ্ধবিরতির পক্ষে সমর্থন প্রকাশের পর নেতানিয়াহুর সঙ্গে তৃতীয়বার ফোনে কথোপকথন করেন জো বাইডেন। এখন পর্যন্ত নানা উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় ৬৫ শিশুসহ কমপক্ষে ২৪৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ফিলিস্তিনি। শিশুদের কান্নার আহাজারি দেখেও কি বিশ্বনেতাদের মনে হয় না যে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা দরকার? আর কত প্রাণহানি হলে বিশ্বনেতাদের এবং জাতিসংঘের ঘুম ভাঙবে?
ফিলিস্তিনে টানা ১০ দিন ধরে বিমান হামলা ও বোমা বর্ষণ করেছে ইসরায়েল। নির্বিচারে হত্যা করছে নারী, শিশুসহ বেসামরিক লোকজনকে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে গোটা গাজা নগরীকে। উগ্র ইহুদিদের আক্রমণ থেকে বাদ যাচ্ছে না দাতব্য কার্যক্রম, মিডিয়া কার্যালয়, আবাসিক ভবন। এমনকি স্কুল ও হাসপাতালে ও টানা বিমান হামলা চালিয়ে তারা। হত্যাযজ্ঞে মত্ত ইসরায়েল সর্বশেষ গত সোমবার গাজায় অবস্থিত কাতারের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যালয়ে হামলা চালায়। বিমান হামলা থেকে রক্ষা পায়নি গাজার প্রধান করোনা টেস্ট সেন্টার। এতে বন্ধ হয়ে গেছে ওই হাসপাতালের কার্যক্রম। এ আগ্রাসনকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা প্রয়োজন।
ইসরায়েলের এসব বিমান হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন আইনজ্ঞরা। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আরদি ইমসেইস বলেছেন, গাজা উপত্যকার অসমর্থিত বাহিনীর মোকাবিলায় ইসরায়েল যা করছে, তা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল প্রাথমিকভাবে স্বাতন্ত্র্য, আনুপাতিকতা ও সতর্কতার নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে যুদ্ধাপরাধ করছে, তা বিশ্বাস করার মতো বিশ্বাসযোগ্য কারণ রয়েছে।’
এ রকম যুদ্ধবিগ্রহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকলে মানবতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে যে–সংখ্যক শিশু মারা গিয়েছে, তাতে প্রমাণিত যে এদের মনে মানবতার লেশমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। তাই এখনই উচিত হবে জাতিসংঘের মাধ্যমে কোনো সমাধানের পথ বেছে নেওয়া। আক্রমণ নয়, পাল্টা–আক্রমণ নয়, বিশ্বনেতা ও রাজনীতিবিদদের উচিত দুই জাতির এই বিবাদের সঠিক ও স্থায়ী মীমাংসা করার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় ৩৮ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে আড়াই হাজার। কী ভয়ানক অবস্থা! জাতিসংঘ এসব বিষয়ে অবগত, তাহলে তাঁরা কেন এ সংঘর্ষ থামাচ্ছে না। এই সংগঠন কিসের জন্য তৈরি করা হয়েছে? এর কোনো ভূমিকা নেই। অর্থাৎ এ ধরনের সংগঠনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না, তা মনে প্রশ্ন জাগে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরায়েল গাজায় ১৭টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানকার একমাত্র করোনা পরীক্ষার ল্যাবটিও অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, গাজার প্রায় ৮ লাখ অধিবাসীর জন্য পানীয় জলের সরবরাহ লাইন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য বর্তমান গাজা উপত্যকা চরম মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব তথ্য থেকে ধারণা করা যায় ফিলিস্তিনিরা কী চরম বিপর্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে। কতটা অমানবিক সমাজ হলে এটা করতে পারে, আমরা কি ভাবতে পারি কী হতে যাচ্ছে সেখানে? এর দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক স্থানে ইসরায়েলবিরোধী মানববন্ধন ও প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদ হওয়া একান্ত প্রয়োজন ছিল, মানুষ তো মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ধর্ম তো কোনো পরিচয় না, পরিচয় হলো মানুষ। বিশ্বের সবাই মানুষ, সবাইকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। একমাত্র সবাই সোচ্চার হলে পৃথিবী থেকে এ ধরনের অন্যায়–অত্যাচার বন্ধ হবে, অন্যথায় এ ধরনের ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড চলতে থাকবে। জাতিসংঘের উচিত ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং অবিলম্বে এ ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করা।
যদিও জাতিসংঘ এখানে হাস্যকর ভূমিকা পালন করছে। সময় হয়ে গেছে মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র জাতিসংঘ তৈরি করার। অনেক মুসলমান রাষ্ট্র ইসরায়েলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছে। তাদের বলতে চাই, এই অন্যায়ের পথ থেকে সরে আসুন, নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করুন, যাতে মুসলমান মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে। আগ্রাসন থেকে বাঁচার উপায় সন্ধান করুন। এরা সর্বদা মানুষ হত্যায় লিপ্ত থাকে। আমাদের ইতিহাসের নিকৃষ্ট জাতি হিসেবে পৃথিবীতে স্মরণ করা হবে তাদের। শুধু হামলাকারী ইসরায়েল নয়, যারা এ হামলায় সমর্থন দেয়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া উচিত। ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের ওপর ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে গাজায় শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে মালয়েশিয়া। তাই আমি মনে করি, জাতিসংঘের উচিত হবে আরও অনেক দেশ থেকে ফিলিস্তিনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা।
কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যম তাদের পেশাদারত্ব মানছে না, তারা তাদের মিডিয়াতে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরছে না, বরং অন্য কথা লিখছে। ফিলিস্তিনিদের যেকোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদকে কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের তকমা দিয়ে থাকে। যদিও এই রীতি অনেক পুরোনো। তারা কোনো সভা বা সমাবেশ করলে এটাকে বলা হয় সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর সম্মেলন। তাদের ভূখণ্ডে ইসরায়েলিরা বিল্ডিং তৈরি করতে গেল, জমি দখল করতে গেল কোনো সমস্যা নেই এবং বিশ্ব মিডিয়াতে তা প্রকাশ পায় না। বরং তারা প্রতিরোধ করলে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এতে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিচার থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যায়। ফিলিস্তিনের জাতিগত মুক্তিসংগ্রাম ইসলামের সঙ্গে মিলিয়ে না ফেলে, ফিলিস্তিনিদের শুধু ‘মুসলমান’ হিসেবে না দেখে, তাদের মানুষ ভেবে নিরীহ শিশুহত্যা এবং গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়া উচিত।
সর্বোপরি, ফিলিস্তিনের পশ্চিম জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের ব্যবহার ও নির্বিচারে হতাহত করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বিশ্ববিবেক জাগ্রত হোক, মানুষের মধ্যে সুবুদ্ধি, শুভ চিন্তার উন্মেষ হোক, শান্তি ফিরে আসুক।
লেখক: মো. শফিকুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ