স্বপ্ন যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
আজ আমি যে গল্পটা শেয়ার করতে যাচ্ছি তা আমার জীবনের গল্প।
আমি মনে করি পরিশ্রম, ভাগ্য এবং তারপর আসে সফলতা। প্রত্যেকটা মানুষেরই নানা রকমের স্বপ্ন থাকে, তাহলে আমি কেন এর বিপরীত থাকব। তাই হাজারো স্বপ্নের মাঝে আমার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল। আমি মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পড়াশোনা করেছি। সময়টা ২০১৬ সাল, দাখিল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর প্রহর গুনছিলাম কবে পরীক্ষা আসবে। অবশেষে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। ভালোভাবেই সব পরীক্ষা শেষ করলাম। এখন ফলাফলের অপেক্ষা। ভাবছিলাম ভালো কিছুই হবে, কিন্তু হলো উল্টোটাই। একে তো দাখিলে ফল ভালো হলো না, তারপর আলিমে (২০১৮) ভালো ফলাফলের জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। আপু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তাই আমাকেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে এই আশায়। তবে প্রথমে ঠিকঠাকমতো পড়াশোনা করতাম না, আমি চাইনি তবুও পরিবার মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছে। এত কিছুর পরও মনে স্বপ্ন জাগল যে আমাকে ভালো কিছু করতে হবে।
আলিম পরীক্ষা ভালো করেই দিলাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করার জন্য রংপুরে গেলাম। কোচিংয়ে ভর্তিও হলাম, কিছুদিন ক্লাস করার পরই ফল দেওয়ার পালা। আশানুরূপ ফলাফল করতে পারলাম না। ভাবলাম ফরম তোলারই তো যোগ্যতা রাখলাম না। এ ফল দিয়ে কিছু হবে না। মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়লাম। তখন কোচিংয়ের শিক্ষক একদিন ফোন দিয়ে কোচিংয়ে ডাকলেন এবং বললেন ফলাফল কোনো ফ্যাক্ট না, তুমি লেগে থাকো, ইনশা আল্লাহ ভর্তির সুযোগ তোমার হবেই। ভাইয়ার কথায় আশ্বাস নিয়ে আমিও এগোতে থাকলাম গন্তব্যের দিকে। জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার কিছু সময় কেটেছে সেকেন্ড টাইমার হিসেবে। পরিবার, সোসাইটি, ফ্রেন্ড সার্কেল, শিক্ষক সবারই একটা আলাদা এক্সপেকটেশন ছিল, পূরণ করতে পারিনি।
ভর্তি পরীক্ষার সময় একটু কষ্ট করুন, ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম বাদ দেন, সফলতা আসবেই, বিশ্বাস করুন, আসতে বাধ্য। রেজাল্ট ফ্যাক্ট না। একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, আজ কষ্টকে যদি আপনি সাময়িক সময়ের জন্য কুর্নিশ করেন, কাল সফলতা আজীবনের জন্য কুর্নিশ করতে বাধ্য
প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায়...
২০১৮ সালে আলিম পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর রংপুরে চলে এলাম ভর্তি কোচিংয়ের জন্য। তখন পর্যন্ত জানতাম না অ্যাডমিশন আসলে যোগ্যতার সঙ্গে ভাগ্যেরও খেলা। ৪ মাস কোচিং করার পর, অ্যাডমিশন দেওয়ার জন্য যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় গেলাম, পরীক্ষাও দিলাম, পয়েন্ট খারাপ হওয়ায় ১ম পরীক্ষার রেজাল্টের পরই যখন লাল কার্ডটা হাতে করে নিয়ে ফিরলাম, ঠিক তখনই শুরু হলো ধাক্কা আর ধাক্কা। শুরু হলো লাইফের ইউটার্ন। সব কোচিং সেন্টার তখন বন্ধ দিয়ে দিয়েছে, রংপুরে খোলা আছে শুধু ঊষা কোচিং। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ফরমই তোলার সৌভাগ্য হয়নি। সবাই বলছে কুষ্টিয়া ভালো আর ওখানে আমার চান্স হওয়ার পসিবিলিটি বেশি, ফরম তুললাম। ভালোভাবে পরীক্ষা দিলাম, হলো না। একে একে বেশ কয়েক জায়গায় ফরম তুললাম, পরীক্ষা দিলাম। তারপর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কোচিং ও আর পড়াশোনায় দিন কাটছিল। পরীক্ষা যখন এল তখন সুন্দরভাবে পরীক্ষা দিয়ে ভাবলাম এবার বুঝি কষ্ট সার্থক হবে, সবার আশা পূরণ হবে। ফল বেরোল কিন্তু সিরিয়াল দূরে এল। ভাবলাম, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, এমনি বাবার টাকাপয়সা নষ্ট করলাম। ভার্সিটি পড়ব বলে ন্যাশনালেও ভর্তি হইনি। পণ করলাম সেকেন্ড টাইম দেব...
দ্বিতীয়বার
টার্গেট কুষ্টিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। যে করেই হোক, রংপুরে আমাকে থাকতেই হবে, চান্স পেতেই হবে, টার্গেট মিস করা যাবে না। আবারও শাহআলম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঊষা কোচিংয়ে ভর্তি হলাম রংপুরে। এরপর পুরোদমে লেখাপড়ার প্রস্তুতি নিলাম। প্রতিদিন কোচিংয়ে আসা–যাওয়া, মডেল টেস্ট দেওয়া এগুলো চলছিল। তখন আমার রুটিনটা ছিল মোটামুটি এ রকম, সকালে ঘুম থেকে ফ্রেশ হয়েই শুরু, তারপর কোচিংয়ে যাওয়া, দুপুরে গোসল, নামাজ, খেয়ে আবার এক দফা। একটু ঘুমিয়ে মাগরিবের আগপর্যন্ত আরেক দফা। মাগরিব থেকে এশা। তারপর এশা থেকে শুরু করে রাত ১টা- ২টা পর্যন্ত। আবার কখনো কখনো সারা রাত চলে যেত কোচিংয়ের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে। আমার আবার আওয়াজ না করে পড়লে হতো না, তাই সব সময় মেসের ছাদে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পড়তাম। সবকিছুর মাঝেও সৃষ্টিকর্তাকে ভুলতাম না, সব সময় তাঁকেই স্মরণ করতাম। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান আমরা যেই ধর্মেরই হই না কেন, আমাদের সৃষ্টিকর্তা আছেন। আমি বিশ্বাস করি সৃষ্টিকর্তা পারেন না এমন কিছু নেই।
তখন কেন জানি বন্ধু, আড্ডা এই ব্যাপারগুলো মাথায় আসতে চাইত না। তবুও মন ভালো রাখার জন্য মাঝেমধ্যে নিশি, ঝরনা, বীথি, মেসের বড় আপু, বৃষ্টি আপু (রুমমেট) হাসি, খুশি আপু ও অন্যান্য আপুদের সঙ্গে গল্প করতাম। বাসা থেকে মা-বাবা, আপু ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিত, পড়াশোনা কেমন চলছে? বলতাম ভালো, সবার কথা মনে পড়লেই কলিজা যেন কেমন করে উঠত। ভাবলাম এবার আমার ভর্তি হওয়া লাগবেই। লাইফটা তখনো মূল্যহীন। চোখে–মুখে একটাই স্বপ্ন, একটা সিট, একটা পাবলিক ভার্সিটি। ফেসবুক, নাটক, মুভিগুলোতে প্রচণ্ড এডিক্টেড ছিলাম। বুঝলাম এটা আমার মনোযোগ নষ্ট করছে। রাখলাম না কিছুই। সবকিছু ডিএক্টিভেট করে দিলাম পরীক্ষার ১ মাস আগে। টার্গেট একটাই। চান্স চান্স চান্স। বশেমুরবিপ্রবি ও অন্যান্য পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিল। প্রস্তুতি চলছে। যথারীতি পরীক্ষাও দিলাম কয়েকটিতে।
পাবনায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগের দিন ১ম পরীক্ষার রেজাল্ট দিল, পয়েন্ট কম থেকেও সিরিয়াল এল, নিশ্চিত ছিলাম না যে চান্স হবে কি না। মোটামুটি থ মেরে গেলাম। কী করব না করব বুঝে উঠতে পারলাম না। এই বুঝি রংপুরে থাকা আর হলো না আমার। স্বপ্ন বুঝি ভেঙে গেল। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হাল ছাড়লাম না, এখনো পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এখনো রংপুরে থাকার সুযোগ আছে আমার। ভেঙে পড়লাম না। নতুন করে লাগলাম। মনে তখন একটাই বাক্য ‘হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখিনি’। নতুনভাবে প্রস্তুতি নিলাম। ফরম তুললাম বেশ কয়েক জায়গায়। এই ভাই, আপু এবং একমাত্র কাছের বন্ধু উৎসাহ দিতে থাকলেন। আইডিয়া, টেকনিক দিতে থাকলেন। সবাই মোটিভেট করলেন আমাকে। এই মানুষগুলোকে আমি আজীবন মনে রাখব।
অতঃপর রোকেয়ার পরীক্ষাও হয়ে গেল। যথেষ্ট ভালো হলো। চিন্তা হচ্ছিল আদৌ সুযোগ হবে কি না। কেননা সবাই বলছেন, এখানেও সবাই অনেক ভালো পরীক্ষা দেয় আর আমার তো পয়েন্ট কম। যাহোক, ফল দিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে ওয়েটিং এল। একে একে অন্যগুলোতেও সিরিয়াল এল, শুধু কুষ্টিয়ায় রিটেনে ১–এর জন্য মিস গেছে। তারপর বশেমুবিপ্রবি থেকে ডাক এল ভর্তিও হলাম ডি ইউনিটে। কিন্তু এখানে এসে আবার যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এটাই ছিল আমার সফলতার গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর সেই না ঘুমানো রাতগুলোকে কিছু মনেই হয়নি, সব কষ্টই যেন নিমেষেই মুছে গেছে, সফলতা হয়ে মিশে আছে। বিশ্বাস করতাম, আজ কষ্টকে যদি আমি সাময়িক সময়ের জন্য কুর্নিশ করি, কাল সফলতা আমাকে আজীবনের জন্য কুর্নিশ করতে বাধ্য। অনেকেই অনেক কিছু বলত কিন্তু সব সময় পাশে ছিল আমার পরিবার। সেকেন্ড টাইমার? এটা তোমার ব্যর্থতা না। ভুল সবাই করে। ভুল করে বলেই তুমি মানুষ। ভুল আমারও ছিল। আমি যদি ভালো রেজাল্ট করতাম, তবে ফার্স্ট টাইম এই আগেরবারই হয়তো নিজের নামের পাশের ভার্সিটি ট্যাগটা লাগাতে পারতাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া। স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে। ভর্তি হয়ে গেলাম ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
পরিবার, কোচিং, নাহিদ, হাসি, খুশি আপু, বৃষ্টি আপু, আরও অনেক আপু যেভাবে আমাকে উৎসাহ দিতেন, তাঁদের কথা কখনো ভুলব না। তাঁদের জন্যই হয়তো আজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি। কৃতজ্ঞ তাঁদের প্রতি, কৃতজ্ঞ হে সৃষ্টিকর্তা আপনার প্রতি।
সুতরাং, যাঁরা এবার ভর্তি পরীক্ষা দেবেন, তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, নিজেকে নিয়ে ভাবুন, নিজেকে সময় দেন, সৃষ্টিকর্তার ইবাদতে সময় দেন। বিশেষ করে ভর্তির সময় একটু কষ্ট করুন, ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম বাদ দেন, সফলতা আসবেই, বিশ্বাস করুন, আসতে বাধ্য। রেজাল্ট ফ্যাক্ট না। একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, আজ কষ্টকে যদি আপনি সাময়িক সময়ের জন্য কুর্নিশ করেন, কাল সফলতা আজীবনের জন্য কুর্নিশ করতে বাধ্য।
লেখক: সিনথিয়া সুমি, শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।