সেলুন পাঠাগার
সেলুনে লম্বা সিরিয়াল। কেউ চুল কাটাবে, কেউবা দাড়ি সেভ করাবে। দীর্ঘ এ সময় কারও কাটে ফোন টিপে, কারও–বা পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে। তবে এ সময় যদি বই পড়া যেত, জ্ঞান আহরণে মশগুল থাকা যেত। তাহলে বইপ্রেমীদের জন্য ব্যাপারটা কেমন হতো? নিশ্চয় ভালো। জ্ঞানপিপাসুদের কথা মাথায় রেখে এবার তেমনি একটি সেলুন পাঠাগার গড়ে উঠেছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে।
সৈয়দপুর উপজেলার তুলসীরাম সড়কের পাশে অবস্থিত বিসমিল্লাহ সেলুন। বাইরে থেকে দেখে এ সেলুনকে অন্য সব সেলুনের মতোই মনে হবে। কিন্তু ভেতরে গেলেই বদলে যাবে দৃশ্যপট। মনে হবে, যেন সেলুনের মধ্যেই একটুকরা পাঠাগার। ব্যতিক্রমী সেলুনটি গড়ে তুলে সাড়া ফেলেছেন শাহজাদা ইসলাম (৩০) নামের একজন সেলুনের কারিগর। আর তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেছে সৈয়দপুরের সেতুবন্ধন পাঠাগার।
শাহজাদার সেলুনে দেখা মিলবে একটি রেকের। এ রেকে তাক করে সাজানো রয়েছে বেশ কিছু বই। এখানে আছে ইতিহাস, সাহিত্য, গবেষণা, মনীষীদের জীবনী ও ধর্মবিষয়ক বিভিন্ন বই। সেলুনে গিয়ে দেখা যায়, একজন গ্রাহক চুল কাটাচ্ছেন। বাকিরা নির্বিঘ্নে বই পড়ছেন। জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে অপেক্ষমাণ সময়টা কাটাচ্ছেন।
বিসমিল্লাহ সেলুনের এ পাঠাগারে আছে ৫০টির মতো বই। প্রতি তিন মাস পরপর বই পরিবর্তন করা হয়। দোকানের গ্রাহকেরা চাইলে সেলুনেই সময় নিয়ে বই পড়তে পারেন। প্রয়োজনে বাড়িতে নিয়ে গিয়েও পছন্দের বই পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন খাতায় নাম নিবন্ধন করতে হবে। বিসমিল্লাহ সেলুনের স্বত্বাধিকারী শাহজাদাও একজন বইপ্রেমী। কাজকর্মের ফাঁকে তিনি নিজেও বই পড়েন এবং অন্যদেরও বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন।
২০২০ সালে বিসমিল্লাহ সেলুনে মাত্র ২০টি বই দিয়ে যাত্রা শুরু করে সেলুন পাঠাগার। ধীরে ধীরে এ পাঠাগারের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু নিয়মিত পাঠকও তৈরি হয়েছে। তাই তো সৈয়দপুরের শিক্ষানুরাগীদের কাছে শাহজাদার এ সেলুন পাঠাগার যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি শাহজাদার দোকানে গ্রাহক বৃদ্ধি পাওয়ায় আয়ের পথও সুগম হয়েছে।
শুরু থেকেই ভিন্নধর্মী সেলুন পাঠাগারটি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত সেতুবন্ধন পাঠাগারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সৈয়দপুরের খাতামধুপুর ইউনিয়নের খালিসা বেলপুকুরের সেতুবন্ধন পাঠাগারের সদস্যরাই মূলত এখানে বই প্রদান করেছে। পাঠকসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার বন্দোবস্ত করেছে। পাশাপাশি সৈয়দপুরে আরও কিছু সেলুন পাঠাগার গড়ে তোলার প্রয়াস চালাচ্ছে।
বিসমিল্লাহ সেলুনে চুল কাটতে আসা একজন শিক্ষক আলমগীর সরকার জানান, ‘সব সময় এখানেই চুল কাটাই। এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো। বই পড়ার জন্য সুন্দর একটি আবহ তৈরি করা হয়েছে। অন্য সেলুনগুলোতে যেখানে সিনেমা ও গান বাজিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা হয়, সেখানে বিসমিল্লাহ সেলুনের ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়।’
সেলুনের আরেক গ্রাহক শিক্ষার্থী মুহিত বলেন, ‘প্রথমবারের মতো এখানে চুল কাটাতে এসেছি। দেখে খুব ভালো লাগল যে এখানে বই পড়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাই চুল কাটাতে দেরি হলেও সময়টা ভালোই কাটছে। সেলুনটির এ রকম উদ্যোগ আমাদের বই পড়তে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করবে।’
বিসমিল্লাহ সেলুনের স্বত্বাধিকারী শাহজাদা জানান, ‘আমি এসএসসি পাস করেছি। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। সময় পেলেই বিভিন্ন উপন্যাসের বই পড়ি। সেতুবন্ধন পাঠাগারকে অনেক ধন্যবাদ। আমার দোকানে এ রকম একটি সেলুন পাঠাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। আমার দোকান যত দিন থাকবে এই পাঠাগারও তত দিন থাকবে।’
*শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা