সিলেটের সুড়ঙ্গ ‘হারং হুরুং’ ঘোরাঘুরি

সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ

আবিষ্কারের নেশা মানুষকে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীব্যাপী ঘরছাড়া করে রেখেছে। মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য খুঁজে বের করতে অরণ্য, জঙ্গল, সমুদ্র কিংবা পাহাড় কোনো কিছুতেই পা ফেলা বাদ দেয়নি। ৩ জুন বিশ্ব সাইকেল দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়। বিশ্বজুড়ে পঞ্চমবারের মতো সাইকেলপ্রেমী ও পরিবেশবাদীরা আয়োজন করে পালন করছেন দিনটি। ২০১৮ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় বিশ্বনেতারা ঠিক করেন, পরিবেশের ক্ষতি না করে দীর্ঘ সময় ধরে যে পরিবহনটি মানুষের সঙ্গী হয়েছে, সেটিকে উদ্‌যাপন করা দরকার। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রতিবছর ৩ জুন বিশ্ব সাইকেল দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রতি শুক্রবার সিলেট সাইক্লিং কমিউনিটি ভোর সাতটায় নিয়মিত সাইকেল রাইডে বের করে। যুবক-যুবতী কিংবা বায়োজ্যেষ্ঠ কেউই বাদ যান না এ রাইড থেকে। সাইকেল দিবসের দিনেও প্রতি সপ্তাহের মতো নিয়মিত রাইড বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবহাওয়া হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় ওই দিন সকালটা ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে। যথারীতি সকাল সাতটার আগেই আমি রাইডের নির্দিষ্ট পয়েন্টে গিয়ে হাজির হয়ে যাই। জায়গাটিকে সুবিদবাজার পয়েন্ট বলা হয়। এখান থেকে প্রতিটি সাপ্তাহিক রাইড বের হয়। পয়েন্টে এসে দেখি বৃষ্টি খুব বেশি একটা নেই। তা–ও কেউ বের হয়নি। এর মধ্যে সময় সকাল সাতটা পেরিয়ে গেলে বৃষ্টির কারণে আজকের রাইডটি বাতিল করা হয়।

সময় পেরিয়ে গেলে সেখানে আমিসহ আরও দুই যুবক তাঁদের সাইকেলসহ হাজির হন। রাইড বাতিল হয়ে যাওয়ায় তাঁদেরও মন খারাপ। তখন সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিই বেরিয়ে পড়ার। তারই অংশ হিসেবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সিলেটের প্রাচীন সুড়ঙ্গ ‘হারং হুরং’ জয় করব। আর তখনি সাইকেলের প্যাডেলে নিজেদের ইচ্ছাকে শক্তি বানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

সিলেটের মালনীছড়া চা–বাগানের অন্তর্গত হিলুয়াছড়ার ১৪ নম্বর সেকশনে এ সুড়ঙ্গ। সিলেটি ভাষায় ‘হারং’ মানে সাঁকো বা বিকল্প পথ আর ‘হুরং’ মানে ‘সুড়ঙ্গ’। অর্থাৎ ‘হারং হুরং’ মানে হলো বিকল্প সুড়ঙ্গপথ। ছোট পাহাড়ঘেরা একখণ্ড ফাঁকা জায়গা। এরই এক পাশে সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ। ভেতরে খুবই এবং ভেতরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বিষধর সাপ, পোকামাকড় থাকা খুবই স্বাভাবিক। হয়তো অনেক রহস্যও লুকিয়ে রয়েছে এখানে। দক্ষ কাউকে নিয়ে এলে হয়তো এর ভেতরটা দেখা যেতে পারে। যদিও তেমন দুঃসাহস এখন পর্যন্ত কেউ করেনি।

সুবিদবাজার পয়েন্ট থেকে সাইকেল চেপে মালনীছড়া বাগানে পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছে সাত-আট মিনিট। তারপর মালনীছড়া থেকে প্রবেশ করে ফেললাম হিলুয়াছড়া চা–বাগানের রাস্তা ধরে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে বাগানের বালুময় রাস্তা অনেকটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকায় সাইকেল খুব বেশি গতিতে চালানো সম্ভব হয়নি। তবু ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হিলুয়াছড়া চা–বাগানে। সেখানে একটা দোকানে চা খেয়ে হালকা বিশ্রাম নিয়ে নিলাম আমরা। তারপর একজন বাগানশ্রমিকের কাছে সুড়ঙ্গের রাস্তা জানতে চাইলে তিনি দুটি ছোট ব্রিজের কথা বলে দেন। আমরাও ওনার কথামতোই পথ ঠিক করে নিলাম।

তারপর তাঁর কথা ধরে অনেক দূর যাওয়ার পর ঝরনার শব্দ কানে এল আমাদের। চারপাশের পরিবেশটা অনেকটা ভুতুড়ে লাগছিল। দিনটা শুক্রবার থাকায় চা–বাগানে পাতা তোলা বন্ধ, এ জন্য কোনো বাগানশ্রমিক বাগানে যাননি সেদিন। প্রকৃতি আর পাখপাখালি ও কীটপতঙ্গের শব্দ ছাড়া আশপাশের চার–পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে মানবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। সাইকেল থেকে নেমে আমরা পানির শব্দ ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম। একটু এগোতেই দেখি একটি বিশাল পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি নামছে। পানির গতি বেশি থাকায় এটিকে মনে হচ্ছিল ছোট একটি ঝরনা। আর পানির শব্দও ঝরনার মতোই। ছড়া থেকে খাবার পানি নিয়ে একটু বিশ্রাম করে আবারও আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুড়ঙ্গ খুঁজতে। কিন্তু ততক্ষণে আমরা ওই চা–শ্রমিকের নির্দেশনা দেওয়া রাস্তা ভুলে গেছি। দুটি ব্রিজের কথা থাকলেও আমাদের সামনে ব্রিজ পড়ে পাঁচটি। ফলে কোন ব্রিজ থেকে ডানে আর বাঁয়ে যাব, তা নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর এদিকে কারও ফোনেই মোবাইল নেটওয়ার্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে অনেক খোঁজাখুঁজি আর ডাকাডাকির পর কাউকে না পেয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই একটি অনিশ্চিত পথ ধরে সামনে এগোব। তাতেও যদি আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য খুঁজে পাই। একটা কথা আছে, ‘পথ কখনো পথিককে সৃষ্টি করতে পারে না, আবার নিজে নিজে তৈরি হয় না। পথিকই নিজের ও দশের প্রয়োজনে পথের সন্ধান করে বা তৈরি করে। আবার পথিক নিজের অগ্রযাত্রা এবং যাত্রা যাতে সহজতর হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে পথের সৃষ্টি করে। তবে সব পথই সঠিক ও যথার্থ হয় না।’ আর আমরাও সেই অনিশ্চিত গন্তব্য ধরে সামনে এগোতে দ্বিধাবোধ করি না। কিছু দূর গিয়ে মনে হচ্ছিল একেবারেই পথ হারিয়ে ফেলেছি আমরা। এর মধ্যে আমাদের ঘেরাও করে ফেলে একদল পাহাড়ি বানর। অবস্থার অবনতি দেখে রাস্তায় পড়ে থাকা বাঁশের কঞ্চি দেখে আমরা একটি বাঁশের খুঁটি হাতে নিয়ে নিলাম নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য। এরপর আবার সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। এই পথ শেষাবধি গিয়ে আর কোনো মানুষের পায়ের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। সুড়ঙ্গ কোথায়, সেটাও জানা নেই আমাদের। ফলে এই জনমানবহীন অরণ্যে বন্যদেবতা ‘টারবারু’র শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিলাম না আমরা।

চারদিকে টিলা আর বন। সুড়ঙ্গ না পেয়ে সেখানে বিশ্রাম নিতে বসে যাই আমরা। আর এর মধ্যেই প্রথম আমার চোখে পড়ে পাশে একটি গাছের গুঁড়িতে মোমবাতি ও আগরবাতির পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষের। আমার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগে, এত গভীর অরণ্যে কে এসে পূজা দেয় তার দেবতাকে আর কোন দেবতাই–বা এখানে নিজের সমাধি রেখে গেছে? প্রশ্নের ঘোর কাটতেই আমার মনে পড়ে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা সুড়ঙ্গটিকে পূজা করে এবং এটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে ভক্তি দেয়। ঠিক তখনই একটু গভীরে তাকিয়ে দেখি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সে সুড়ঙ্গ আমরা পেয়ে গেছি। যার জন্য এত পরিশ্রম করে এই গভীর অরণ্যে এলাম, আর তার কাছে বসে থেকেই তাকে খুঁজে না পেয়ে দুই মিনিট আগেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা ফিরে যাব। কিন্তু সেই রহস্যময় সুড়ঙ্গটিকে জয় করেই ফেললাম। অবশেষে বিশ্বসাইকেল দিবসটিও আমার কাছে সফল হয়ে গেল।

যেভাবে আসবেন ‘হারং হুরুং’ সুড়ঙ্গে

ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, সৌদিয়া, এস আলম, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে সিলেট। শহর থেকে মালনীছড়া চা–বাগান যেতে পারেন। ভাড়া রিকশায় ৩০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে। নন এসি-এসি ভাড়া ১৫০ থেকে ১০১৮ টাকা। সিলেটের আম্বরখানা থেকে অটোরিকশায় সেখানে যাওয়া যায়। গাইড হিসেবে একজন চা–শ্রমিক সঙ্গে নিলে ভালো হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়