সাইকেলে পাহাড় জয়
মানুষ শখ করতে ভালোবাসে। শখ পূরণের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি থাকতে নেই। তাই তো এক ব্যতিক্রমী শখ সাইকেল চালিয়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে চূড়ায় চড়ে বেড়িয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং(ইইই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরোজ আহমেদ।
ইমরোজের স্বপ্ন ছিল সাইকেলে চড়ে পাহাড়ে যাওয়ার। সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াবেন দেশের পর্বত থেকে পর্বতে, আনাচকানাচে, পথে–প্রান্তরে। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় সাইক্লিং গ্রুপ আছে, যারা বিভিন্ন সময় সাইকেলে চড়ে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে। কিন্তু বশেমুরবিপ্রবিতে এ ধরনের কোনো সংগঠন না থাকায় সাইকেলে চড়ে পাহাড় জয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছিল ইমরোজের। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে চট্টগ্রামের একটি সাইক্লিং গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্প্রতি বেশ বড় একটি ভ্রমণ শেষ করেছে ইমরোজ।
নয়জন সদস্যের সাইক্লিং গ্রুপটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি-বান্দরবান-থানচি-আলীকদম-চকরিয়া-মহেশখালী হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি আবার চট্টগ্রামের একই জায়গায় এসে যাত্রা শেষ করে। এই সাত দিনে তারা অতিক্রম করেছে ৫৬০ কিলোমিটার পথ, এর মধ্যে ৫ হাজার ৯৯৪ মিটার ছিল এলিভেশন গেইন।
সাইকেলে চেপে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৫০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ডিম পাহাড় জয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, তা নিয়ে কথা হয় ইমরোজের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাইক্লিং করে পাহাড় জয়ের নেশা ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সাইক্লিং গ্রুপ না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না। চট্টগ্রামে আমার দুই বন্ধু তাসিন ও অনীকের মাধ্যমে পাহাড় জয়ের আইডিয়া মাথায় আসে, সেখান থেকে পরিকল্পনা শুরু। তাসিন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ছাত্র, অনীক চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
ইমরোজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের জন্য একরকম স্বপ্নের রাইড ছিল এটি। চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় সাইকেলে যাওয়া অনেক সাইক্লিস্টের স্বপ্ন থাকে। আমরা তিন পার্বত্য জেলা (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান) অতিক্রমের পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচু সড়ক থানচি-আলীকদম পার হয়েছি। সবচেয়ে উঁচু যে রাস্তাটি অতিক্রম করেছি, সেটির নাম ডিম পাহাড়। এটি থানচি থেকে আলীকদম রাস্তার মাঝে ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৫০০ ফুট ওপরে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা আর উঁচু-নিচু এ রাস্তাটা ভয়ংকর, তবে মনোমুগ্ধকর। আমরা গিয়েছি শীতকালে, এই সময় গেলে কুয়াশা আর পাহাড়ের মিশে যাওয়া দেখতে পাওয়া যায়। নিজেকে আকাশের অনেক কাছে মনে হয়। কিছু কিছু জায়গা থেকে নিচের দিকে ছোট থানচি শহর দেখা যায়। এ রাইড ছিল আমাদের সবার সাইক্লিং–জীবনের সব অভিজ্ঞতার পরীক্ষা। আমরা এমন পথ পাড়ি দিয়েছি, যেখানে গাড়ি যেতেও হিমশিম খেয়ে যায়। সবাইকে অনেক ধৈর্য আর অভিজ্ঞতা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে রাইড শেষ করতে হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। তাদের জীবনযাপন যে কতটা কষ্টের, সেটা আমরা অনেক কাছ থেকে দেখেছি আর অনুভব করেছি। তারা প্রতিদিন এই পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম করে। তাদের এক কলসি পানি আনতেও অনেকটা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। এখনো অনেক জায়গা আছে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই। তারপরেও তারা সবার সঙ্গে অনেক আন্তরিক। এই আন্তরিকতাই আমরা বারবার মুগ্ধ হয়েছি।’
সাইকেল চালিয়ে ভ্রমণের বিশেষত্ব অনেক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, শরীর-মন সতেজ থাকে। প্রকৃতিকে খুব কাছে থেকে দেখা যায়, অনুভব করা যায়। বিভিন্ন জেলায় বা এলাকায় ভ্রমণের মাধ্যমে অনেক ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়। সেই এলাকা সম্পর্কে বিস্তর জানার সুযোগ হয়। সঙ্গে জানা হয় নানা অজানা সংস্কৃতি।
নতুন যারা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এই পথে রাইডে আসতে চায়, তাদের উদ্দেশে তরুণ ইমরোজ আহমেদ বলেন, দক্ষ চালক হওয়ার পাশাপাশি লম্বা রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য মনোবলটা থাকতে হবে। সাইক্লিং করে আপনি আনন্দটা অনেক বেশি অনুভব করবেন। একটা রাইড বা ভ্রমণ শেষ করার পর যে আনন্দ-উৎফুল্লতা কাজ করে, সেটা মোটরসাইকেলে নাও পেতে পারেন। সাইক্লিং আগে যতটা কঠিন ছিল, এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। আগে সবাই বলত সাইকেল না চালিয়ে মোটরসাইকেল কিনতে, এত কষ্ট করে চালানোর কী দরকার? কিন্তু এখন যেখানেই যায়, মানুষ সাইক্লিং করাকে অনেক বেশি উৎসাহ দেয়। এ ধরনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যত বেশি ছড়িয়ে পড়বে, দেশে সাইক্লিং করার প্রবণতা আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।
এই তরুণ আশাবাদী, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েও গড়ে উঠবে সাইক্লিং গ্রুপ। আর এই সাইক্লিং গ্রুপ নিয়ে ক্যাম্পিংয়ের উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন রাইডে যাবে দেশের নানা প্রান্তে। যারা কখনো ভ্রমণ করবে উত্তরের বাংলাবান্ধা থেকে দক্ষিণের সাতক্ষীরা শ্যামনগর সুন্দরবন। কখনোবা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, কুয়াকাটা থেকে তামাবিল।
*লেখক: আর এস মাহমুদ হাসান, শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ