সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রসঙ্গ ও কিছু প্রত্যাশা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে বেকারত্ব অন্যতম। বেকার জীবন যেমন একজন ব্যক্তির জন্য অভিশাপ, তেমনি দেশ ও জাতি তথা একটি দেশের অর্থনীতির জন্যও অভিশাপ। বেকার বলতে সাধারণত ওই সব কর্মক্ষম লোকদের বোঝায়, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাজ পান না। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কাজের বাজারের সামঞ্জস্য না থাকার ফলে প্রতিবছর উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। আর এসব শিক্ষিত বেকারের সিংহভাগ ঝুঁকছে সরকারি চাকরির প্রতি। সরকারি চাকরি বর্তমানে সোনার হরিণ। লাখো শিক্ষিত বেকার হন্যে হয়ে সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ও অসংগতি রয়েছে। এসব সমস্যা ও অসংগতি পর্যায়ক্রমে  তুলে ধরা  হলো।

প্রথমত, গুটিকয়েক বাদে প্রায় সব নিয়োগ পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে দেশের চতুর্দিকে থেকে চাকরিপ্রার্থীদের ঢাকায় আসতে হয়। যেহেতু অনেক দূর থেকে ঢাকায় আসতে হয় তাই তাদের মোবাইল ফোন, ঘড়ি, ওয়ালেট, ব্যাগ বা (মেয়েদের ক্ষেত্রে) ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হয়। কিন্তু সিংহভাগ পরীক্ষা কেন্দ্রে এসব নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে সবাইকে বিড়ম্বনা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। বাধ্য হয়ে তাঁদের ওই সব জিনিসপত্র টাকার বিনিময়ে বা অন্য কোনো উপায়ে আশপাশের কোথাও রাখতে হয়, যা মোটেও নিরাপদ নয়। এ ক্ষেত্রে সব পরীক্ষাকেন্দ্রে অস্থায়ী বুথ করা হলে চাকরিপ্রার্থীরা তাঁদের জিনিসপত্রগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপদে রাখতে পারবেন।

ফাইল ছবি

দ্বিতীয়ত, অনেক পরীক্ষাকেন্দ্রে দেয়ালঘড়ি থাকে না। অনেকাংশে ঘড়ি থাকলেও নষ্ট থাকে। ফলে পরীক্ষার্থীদের ঝামেলায় পড়তে হয়। পরীক্ষায় মনোনিবেশের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে। এ ক্ষেত্রে সব পরীক্ষাকেন্দ্রে বাধ্যতামূলক দেয়ালঘড়ির ব্যবস্থা করলে চাকরিপ্রার্থীরা উপকৃত হবেন।

তৃতীয়ত, অনেক চাকরিতে অযৌক্তিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। সদ্য স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করা একজন চাকরিপ্রার্থী কীভাবে অভিজ্ঞ হবেন, যেখানে বয়সের সীমা ৩০ বছর নির্ধারিত। তা বোধগম্য নয়। কয়েক বছর চাকরি করার পরেই তো আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জিত হওয়ার কথা। তাই এসব অযৌক্তিক অভিজ্ঞতা চাওয়া থেকে বিরত থাকাই সমীচীন।

চতুর্থত, অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার দু-এক বছর পরও চাকরির পরীক্ষা নিতে চায় না বা নিতে পারে না। আমি ২০১৮ সালে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করেছিলাম, যেগুলোর পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। ভবিষ্যতে হবে কি না, তা আল্লাহ মালুম। একজন বেকারের যেখানে প্রতিটি দিন একটি চাকরির অপেক্ষায় কাটে, সেখানে দুই-তিন বছর অপেক্ষা করা কতটা কষ্টের, তা একজন বেকারই বুঝতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি পরীক্ষা দ্রুত ও যথাসময়ে নিলে বেকারদের কষ্ট ও অপেক্ষার প্রহর কমবে।

পঞ্চমত, বিশ্বের অনেক দেশে বেকারদের ভাতা দেওয়ার বিধান থাকলেও আমাদের দেশে এর চিত্র বিপরীত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখানে চাকরির আবেদন ফি বাবদ অর্জিত অর্থকে অনেক প্রতিষ্ঠান আয়ের উৎস মনে করে। ফলে অনেক চাকরির আবেদন ফি ৫৬-১৫০০ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়। কিছু চাকরির আবেদন ফি ৫৬ টাকায় নেওয়া গেলে বাকিদের এক হাজার, ১২০০ বা ১৫০০ কেন নিতে হয়? স্বভাবতই একজন বেকারকে পরিবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এমনিতেই অনেকের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করার পর পরিবার থেকে চাপ সৃষ্টি করে এবং আর্থিক সাহায্য কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে প্রতি সপ্তাহে একাধিক আবেদন করতে হয়। এমতাবস্থায় একটি আবেদনের জন্য যদি ফি এত বেশি ধরা হয়, তাহলে বেকারদের অকূলপাথারে পড়তে হয়। এ যেন রীতিমতো মাড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তাই বেকারদের দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে যেন পরীক্ষার আবেদন ফি কমানো হয় এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া যেন নিয়োগ–বাণিজ্যে পরিণত না হয়।

ষষ্ঠত, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে ঘুষ নামক ওপেন সিক্রেট বিষয়। ঘুষের বিনিময়ে চাকরি বেকারদের জন্য গলার কাঁটাস্বরূপ এবং হতাশার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া রয়েছে তদবির ও স্বজনপ্রীতি। অনেক চাকরিতে শুধু মেধাবী হলেই চলে না। থাকতে হয় মামা-খালু এবং টাকা পয়সা। এতে করে প্রকৃত মেধাবীরা যোগ্যতানুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। বছরের পর বছর বেকারত্বের বোঝা বইতে হচ্ছে। তাই ঘুষ, তদবির এবং স্বজনপ্রীতি বন্ধে আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

শেষে বলতে চাই, বেকার সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও উদ্যোগী ও কর্মতৎপর হতে হবে। বেকারত্ব লাঘবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গতি বাড়াতে হবে। সরকারি চাকরির প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বেসরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে এবং আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নিতে হবে। কর্ম ও বাস্তবমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। পাশাপাশি বেকারদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাঁদেরও দৃঢ় শপথ নিতে হবে, কোনোরকম অসদুপায় তাঁরা গ্রহণ করবে না। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন। এভাবে সবার সম্মিলিত চেষ্টার ফলেই চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত হতে পারে। আর কমতে পারে দুর্ভোগ।

*লেখক: মো. নজরুল ইসলাম নোবু, সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

* *নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]