শিমুলবাগানের ‘ফুলকন্যা’ মনিরা-চামেলি
ছবি তুলতে যাব, এমন সময় দৌড়ে আসে শিমুলবাগানের দুই ফুলকন্যা। ভাইজান, একটা মালা নিয়া ছবি তুলেন, ভালা লাগব। মালা দিয়ে ছবি তুললে ভালো লাগে বুঝি? হ, ভালা লাগে। আচ্ছা, তাহলে দাও। ছবি তুলে শিমুল ফুলের মালাটা পুনরায় তার হাতে দিয়ে বললাম, কত দেব, ভাইয়া? ১০ টাকা দিয়া দেন। ২০ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, তোমার নাম কী? মুচকি একটা হাসি দিয়ে ফুলকন্যারা উত্তর দেয়, মনিরা, চামেলি। তারপর খানিকক্ষণের গল্প।
মনিরা বেগম ও চামেলি আক্তার। দুজনের বয়সই সমান। ৮ বছরের মেয়ে দুটির বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের মানিগাঁও গ্রামে। দেশের সর্ববৃহৎ শিমুলবাগান থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছা যাবে মনিরা-চামেলিদের বাড়িতে।
তাহিরপুরের বাদাঘাট ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নাল আবেদীন জাদুকাটা নদীর তীরে প্রায় ৩৩ একর জায়গাজুড়ে রোপণ করেছিলেন ৩ হাজারের মতো শিমুল গাছ। ২০০২ সালে তৈরি করা প্রকৃতিপ্রেমী জয়নাল আবেদীনের এই বাগানে এখন লাল টকটকে শিমুল ফুল ফোটে। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মধ্যে জাদুকাটা নদী আর এপারে শিমুলবাগান। দূর থেকে রক্তের আভার মতো দেখতে এই শিমুল ফুলের বাগানটি মুগ্ধ করে সবাইকে। সুনামগঞ্জ শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ঋতুরাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাসন্তী সাজে সেজেছে জাদুকাটা নদীর বালুময় জায়গাটি। শিমুল ফুলের এই যৌবন দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজারো পর্যটক ছুটে আসছেন জাদুকাটার তীরে।
শিমুলবাগানকে কেন্দ্র করে এই এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ ফুলের মালা বিক্রি করেন, কেউ ছবি তোলেন, কেউ আবার ঘোড়া নিয়ে আসেন। অর্থাৎ নানাভাবে শিমুলবাগানে আসা পর্যটকদের বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের খোরাক দিচ্ছেন এলাকার লোকজন। তাদেরই দুজন মনিরা ও চামেলি। তারা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সেই সঙ্গে ভালো বন্ধুও। মনিরা ও চামেলির মায়েরা জাদুকাটা নদীতে বালু উত্তোলনের কাজ করেন। আর এদিকে সকাল-সন্ধ্যা দুই বান্ধবী ঘুরে বেড়ায় শিমুলবাগানের ৩৩ একরে। সীমান্তঘেঁষা এলাকায় খুবই দুর্বিষহ জীবন তাদের।
মনিরা বলে, ইশকুল বন্ধ, এর লাগি সকালে ২০ টেখা (টাকা) দিয়া বাগানে ঢুকি। পরে বাগানের ফুল তুকাইয়া (কুড়িয়ে) মালা বানাই। এই ফুলের মালা মাথায় দিয়া মানুষে ছবি তুলে, এর বিনিময়ে আমাদের ১০ টেখা দেয়। এভাবে সারা দিনে ১৫০-২০০ টাকা ইনকাম হয়। বাড়ি ফিরে সব টাকা মার কাছে দিয়া দেই। চামেলি বলে, ফুলের মালা বানাই (তৈরি করা) দেখে অনেকে আমাগো ফুলকন্যা বইলা (বলে) ডাকে। কথাগুলো বলেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তারা।
ভুবনজুড়ানো সেই হাসি অসম্ভব রকমের সুন্দর। যেন প্রকৃতির অনবদ্য কাব্য শিমুলবাগানের সঙ্গে খেলা করছিল মনিরা-চামেলির দাঁত কেলিয়ে খিলখিলানিটা। সকাল–সন্ধ্যা পর্যটকদের বিনোদনের খোরাক জুগিয়ে সংসারে মায়ের হাতে টাকা তুলে দেয় শিমুলবাগানের মনিরা ও চামেলি। লাল টকটকে শিমুলের রক্তিম আভার সঙ্গে সারাটা দিন এভাবেই মিশে থাকে বাদাঘাটের এই ফুলকন্যারা।
*লেখক: আশরাফ আহমেদ, শিক্ষার্থী, এমসি কলেজ, সিলেট