শিক্ষিত মানুষের অশিক্ষিত স্বভাব
শৈশবে আমরা যখন নিজের খেলনার চেয়ে বন্ধুর খেলনাটা সুন্দর হলে সহ্য করতে পারতাম না বা সমবয়সী কাউকে প্রশংসা করা হলে মনে মনে জ্বলে উঠতাম; তা ছিল আসলে আমাদের ভেতরজাত সমস্যা। কারণটা হলো, মানুষ জন্মগতভাবে সভ্য হয়ে পৃথিবীতে আসে না। হিংসা, লোভ, ক্রোধ, অহম, কামাকাঙ্ক্ষা, দম্ভ প্রভৃতি সহজাত দোষ নিয়ে আসে। শিক্ষা ও সামাজিকতার মাধ্যমে এই ভেতরজাত সমস্যাগুলোকে উপড়ে মনুষ্যত্ববোধের আলো বের করে আনতে পারলেই ‘প্রাণী মানুষ হয় প্রকৃত মানুষ’। এ শিক্ষা হতে পারে পারিবারিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা অনেকেই শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত হয়েও এ সমস্যাগুলোকে সমূল উপড়ে ফেলতে পারি না। কারণ, ওই দিকে আমাদের মনোযোগ থাকে না, আমাদের মনোযোগ থাকে বহির্জাত বৈভবের দিকে।
যে শিক্ষা মানবিক গুণ প্রজ্বালিত করে, তা আসে প্রধানত সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক শিক্ষা থেকে। এ শিক্ষা আমাদের ভেতরে ত্যাগ, ধৈর্য, উদারতা ও সততার মতো নানান গুণের বাতি লাগিয়ে দেয় আর বাতিগুলো ভেতরের সহজাত অন্ধকারগুলোকে বের করে দেয়। সাধারণত আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই বাতিওয়ালা শিক্ষা থাকে না, নিজ উদ্যোগে তা শিখতে হয়। কেউ কেউ বই না পড়েও ওই রকম আলোকিত শিক্ষায় শিক্ষিতদের সংস্পর্শে গিয়ে আলো পেয়ে যায়। আবার কেউ কেউ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিক্ষক–শিক্ষার্থী হয়েও ওই আলো ধারণ করতে পারে না। কারণ, তাদের মনোযোগ থাকে ক্ষুৎপিপাসাজাত জৌলুসের দিকে। অর্থাৎ নিজের ভেতরে আলো জ্বালানোর ইচ্ছা যদি কারও না থাকে, তবে সেখানে আলো জ্বলবে না। আরেকটা কথা, অনেক ক্ষেত্রে স্বল্পশিক্ষা ভেতরজাত সমস্যাগুলোকে বাড়িয়ে দেয়। স্বল্পশিক্ষিতদের কেউ কেউ দম্ভ ও অহংকারের আগুনে জ্বলতে গিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এসব আমাদের জানা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেও এমন সমস্যাগ্রস্ত মানুষ দেখা যায়। এমন কিছু গল্প আজকের লেখায় তুলে ধরা হবে। গল্পগুলো সমাজ থেকে তুলে নেওয়া, কিন্তু কাল্পনিক।
১. সলিম ও কলিম নয়নপুর স্কুলে একসঙ্গে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ওই পর্যন্ত সলিম ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর কলিমের স্থান থাকত বিশের পরে। সলিম ষষ্ঠ শ্রেণিতে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়। কলিম গ্রামেই থাকে। হঠাৎ করে ক্লাস সেভেনে উঠে কলিমের মধ্যে মনোযোগ আসে এবং এই মনোযোগ ধরে রেখে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কলিম তার বাল্যবন্ধু সলিমকে তারই বিভাগের বন্ধু হিসেবে পায়। কলিম প্রায়ই কথা বলতে চায়। কিন্তু সলিম কলিমকে এড়িয়ে যায়। কারণ, সলিমের মধ্যে প্রাইমারি স্কুলের সেই দম্ভ এখনো কাজ করে, যখন কলিম ছিল খারাপ ছাত্র আর সলিম ফার্স্ট বয়। কলিম অনার্সে ফার্স্ট হয়ে যায়, সলিম হিংসায় জ্বলে ওঠে। শেষে কলিম হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সলিম তার নিজের গ্রামের সেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সলিমের জ্বলুনি এখনো চলমান।
২. অধ্যাপক আজমল খান নির্জনপুর গ্রামের প্রথম ব্যক্তি, যিনি বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং শিক্ষক হয়েছিলেন। আজমল খান যখন বুয়েটে পড়েন, তখন তাদের বাড়িতে জমিলা নামের একজন বিধবা নারী কাজ করতেন। সেই নারীর মোহন নামের তিন–চার বছরের একটা বাচ্চা ছিল। এই মোহন বড় হয়ে পড়াশোনা করে বুয়েটে আজমল সাহেবের বিভাগেই ভর্তি হয়। সব শোনার পর আজমল সাহেব হিংসায় জ্বলে উঠলেও চোরা হাসি দিয়ে তা চেপে রাখে। অধ্যাপকের পরামর্শে মোহন হলে না উঠে তার বাসায়ই ওঠে। কিন্তু মোহন দেখল, এখানে তাকে অনেক কাজকর্ম করতে হয়; তদুপরি আজমল সাহেব লোকজনের সঙ্গে এমন ভাব করেন যেন তার কারণেই মোহন বুয়েটে চান্স পেয়েছে, তার দয়াতেই ঢাকায় আছে। মোহন বুঝে যায় ষড়যন্ত্র। অতিসত্বর বাসা ছেড়ে হলে ওঠে। মোহন অনার্সে ফার্স্ট হয়। এই খবর অধ্যাপক আজমলের হিংসার আগুন বাড়িয়ে দেয়। ফার্স্ট ইয়ারে মোহন যখন ওনার বাসায় থাকত, তখন বলতেন মোহন তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। এরপর থেকে তিনি বলে আসছেন, মোহন তাঁর কাজের বুয়ার ছেলে এবং ওনার কারণেই সে আজ বুয়েটে। মাস্টার্সেও মোহন ফার্স্ট হয়। কিন্তু আজমল সাহেবের কূটনামির কারণে বুয়েটের শিক্ষক হতে পারেনি। মোহন স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে যায় এবং সেখানেই শিক্ষকতার সুযোগ পায়। আজমল সাহেব বলে বেড়ান, আমাদের কাজের বুয়ার ছেলেটা এখন এমআইটির শিক্ষক।
৩. একই গ্রামের দরিদ্র ও কুৎসিত ছেলে কামাল এবং ধনীর দুলাল ও সুদর্শন ছেলে জামাল একই স্কুলে একই শ্রেণিতে পড়ে। কামাল ফার্স্ট বয় আর জামাল খারাপ ছাত্র। এ নিয়ে সহজ–সরল কামালের প্রতি দাম্ভিক জামালের হিংসার আগুন জ্বলে। যা–ই হোক, বড় হয়ে কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর জামাল চতুর্থ গ্রেডের একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। জামালের পড়াশোনায় মন নেই। গার্লফ্রেন্ডের পরামর্শ ও সহযোগিতায় জামাল সিনেমার নায়ক হয়ে যায় এবং শিগগিরই সেলিব্রিটি বনে যায়। কামাল জামালের খবরে খুশি হয় এবং মনে মনে ভাবে, এবার সাংস্কৃতিক পরিবেশে থেকে ও একটু উদার হবে। কিন্তু কিসের কী! হয় উল্টোটা। একদিন জামাল ফেসবুকে লেখে—‘ডায়রিয়া হয়েছে। কী করব?’ এই স্ট্যাটাসে লাইক পড়ে ৫৯৫ হাজার আর কমেন্ট ২৫ হাজার। ঠিক সেদিনই কামালের একটা গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্বখ্যাত জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশ পায়। কামাল ফেসবুকে ওই প্রবন্ধটার লিংক দিয়ে দেয়। এতে লাইক পড়ে মাত্র পাঁচটা, কমেন্ট নেই। এ নিয়ে কামালের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু জামালের দম্ভের ঠেলায় পা মাটিতে পড়ে না!
৪. আকবর সাহেব ও আসগর সাহেব দুজনই শিক্ষিত এবং চাকরি করেন একই কোম্পানিতে। তাঁদের আরেকটা মিল হলো দুজনই ফেসবুকে সময় দেন। আকবর সাহেব নিউজফিডে ভালো কিছু দেখলেই লাইক দিয়ে দেন, পোস্টদাতা তাঁর শত্রু হলেও তিনি তা করেন; এতে তাঁর উদারতা প্রকাশ পায়। অন্যদিকে আসগর সাহেব শুধু অন্যের লাইকের আশা করেন, অন্যের স্ট্যাটাস ভালো হলেও লাইক দেন না। কারণ, অন্যের ভালো কিছু দেখলে তাঁর ভেতরে জ্বলে। এই জ্বলে ওঠার মাধ্যমে আসগর সাহেবের ভেতরের হিংসা, দাম্ভিকতা ও কূপমণ্ডুকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
৫. আনোয়ার ও সানোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণ। আনোয়ার পরোপকার করে আনন্দ পায়। অন্যদিকে সানোয়ার নাম, যশ, অর্থ ও পদবি লাভ করাকেই জীবনের ব্রত মনে করে। আনোয়ার অনার্স ও মাস্টার্স উভয়টাতেই প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। কোথাও চাকরির আবেদন না করে নিজে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দাঁড় করায়। অন্যদিকে সানোয়ার ক্লাসের পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত থাকে; দুটোতেই কোনোমতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। তবে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করে এবং দ্রুতই বড় সরকারি কর্মকর্তা বনে যায়। আনোয়ার তার সংগঠন থেকে দেশের মানুষের জন্য অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে করে যায়, যা সানোয়ারের চিন্তায়ও আসে না। অন্যদিকে সানোয়ার তার পদবি কাজে লাগিয়ে গাড়ি-বাড়ি-নারী অর্জনে ব্যাস্ত থাকে। কিন্তু ফেসবুকে আনোয়ার ও সানোয়ারের অবস্থা সেই কামাল ও জামালের মতো। কারণ, মনে মনে ঘৃণা করলেও এ সমাজের অধিকাংশ মানুষ সানোয়ারের মতোই হতে চায়।
৬. লাবু ও সাবু দুই বন্ধু। লাবু সৃজনশীল, সাবু নকলবাজ। কলেজ পর্যন্ত লাবু সাবুর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর সাবু চালবাজি-নকলবাজি করে অনার্স ও মাস্টার্স উভয়টাতে প্রথম হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বনে যায়। এরপর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র শিক্ষকের থিসিস নকল করে পিএইচডিও করে ফেলে সাবু। ওই দিকে লাবু একটা বড় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও কলামিস্ট। এত কিছু পেয়েও পত্রিকায় লাবুর কলাম দেখলে সাবুর ভেতরে হিংসার আগুন জ্বলে।
একবার দেশের একটা বড় কোম্পানির মালিকানাধীন জনপ্রিয় একটা দৈনিকে সম্পাদক হিসেবে জয়েন করার অফার পায় সাবু। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের ছুটি নিয়ে সানন্দে দায়িত্বটা গ্রহণ করে। সাবুর একান্ত ই–মেইল বরাবর মাঝেমধ্যে নতুন লেখকদের অনেক ব্যতিক্রমধর্মী ও অসাধারণ লেখা আসে। সাবু সেগুলো রেখে দেয় এবং ছয়-সাত মাস পরপর লেখার শিরোনাম বদলে নিজের নামে ছাপিয়ে দেয়।
অধ্যাপক সাবু এবার কলামিস্ট হিসেবে দেশজুড়ে খ্যাতি পায়। যা–ই হোক, হঠাৎ একদিন এক নতুন লেখক তার লেখা বুঝতে পেরে সাবুর নামে মামলা করে দেয়। সাবু ফেঁসে যায়। ডিবি পুলিশ সাবুর পুরোনো ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করে। পত্রিকার সব লেখা, সেই নকল থিসিস, নকল অ্যাসাইনমেন্ট—সব বের হয়ে আসে একে একে!
৭. অধ্যাপক চমক কান্তি বিশ্বাস তার এক ছাত্রের কাছ থেকে ফেসবুক হ্যাকিংয়ের নিয়মটা শিখে নিয়েছিলেন। এ বিধিনিষেধে তাঁর এখন বড় নেশা হলো কোন ছাত্র কোন ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করছে এবং প্রাইভেট মেসেঞ্জারে তারা কী ধরনের বিশ্রী বিশ্রী কথা, ছবি ও পর্নো লিংক চালাচালি করছে; তা গোপনে দেখা। এভাবে অন্যদের প্রাইভেট জিনিস দেখা এখন তাঁর নেশা। আর এসব দেখতে দেখতে তাঁর পড়াশোনা-গবেষণা সব চুলায় গেছে। ডিজিটাল যুগের আগেও অন্যের বিষয়ে নাক গলানো চমক কান্তির অভ্যাসের মধ্যে ছিল বৈকি!
গল্প আরও আছে! আজ এ পর্যন্তই থাক।
সলিম, আজমল, জামাল, আসগর, সানোয়ার, সাবু ও চমক কান্তিরা শিক্ষিত হয়েও সমাজের আবর্জনা। আমরা এমন শিক্ষিত মানুষবিহীন বিশ্ব দেখার অপেক্ষায় আছি। এই জনমে না হোক, হাজার বছর পরে হলেও সেই সময়টা দেখতে আবার ফিরে আসতে চাই।
*লেখক: রাশেদ রাফি, সামাজিক বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষক