শাবিপ্রবি, প্রিয় শিক্ষাঙ্গন জন্মদিনে মুখরিত হয়ে উঠুক
প্রিয় শাবিপ্রবি (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়), মাঝে মাঝে নিজেকে তোমার মাঝেই সঁপে দিতে ভালোবাসি। তোমার পুরো ক্যাম্পাসটাই আমাকে অভিভূত করে রাখে। স্নিগ্ধ আবেশে ক্যাম্পাস চত্বরে এখনো মোহনীয় শোভা খুঁজে পাই। হৃৎস্পন্দনে অনুভব করি তোমার বারতা। তাই বারবার খুঁজে ফিরি তোমার আঙিনা। তোমার মাঝে শিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের চেতনামুখী শিক্ষা সর্বদাই প্রাণবন্ত করে রাখে। ফলে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সমাজের মূল ভিত রচিত হয়। প্রতিফলন ঘটে শিক্ষার মননে, আচার-আচরণে। বহিঃপ্রকাশ ঘটে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
ফাগুনের প্রথম প্রহরে বিশ্ববিদ্যালয়টি নবজন্ম লাভ করে। তাই পাতা ঝরার দিনগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরটি মুখরিত হয়ে ওঠে। এগিয়ে চলার প্রত্যয়ে বসন্তের আগমনী বার্তায় জেগে ওঠে আপন মহিমায়। নবরূপে জানান দেয় আরও একটি নতুন বছরের পদার্পণে।
শুধু শিক্ষার উদ্দেশ্যেই নয়, একটি দেশের আচার-আচরণ কিংবা ওই এলাকার সংস্কৃতি অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সে জন্যই হয়তো স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ ভালো হয় যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’ সুদীর্ঘকাল হতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সান্নিধ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। শিক্ষার অধিকার, আত্মসম্মান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠা সমন্বয়ের উত্তম ক্ষেত্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়। তাই সিলেট বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-সংস্কৃতির আলো প্রত্যাশিত ছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ পয়লা ফাল্গুন তিনটি বিভাগ নিয়ে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।
দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে শাবিপ্রবি। ক্যাম্পাসটি সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে কুমারগাঁওয়ে অবস্থিত। ৭টি অনুষদ, ২৭টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউটসহ বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় এটি। প্রতিষ্ঠাকালীন পরিকল্পনা অনুসারে অনুষদগুলোর অধীনে আরও একাধিক বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
বলা চলে, বিশ্ববিদ্যালয়টি তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম দিকে তিনটি বিষয় নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টির বিস্তার আরও সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে। প্রথাগত উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি উন্মুক্ত দ্বারে আত্মিক প্রতিষ্ঠার পথও সুগম করে তোলে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উৎকর্ষ আরও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে।
মানবসভ্যতায় কল্যাণকামী শিক্ষার অভিমুখই মানবিক। তাই উচ্চশিক্ষার সোপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী মানব কল্যাণের হাতছানি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীরা এক মানবিক আদর্শ খুঁজে পায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। মুক্ত মননশীলতায় বিশ্বাসী শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন বুনন করতে জানে। বিবেকের চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ পায় বলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন ব্যক্তিরা মননে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বিবেকের চেতনায় সৃষ্টিশীল কাজ করার উন্মেষ ঘটিয়ে সৃষ্টিশীলতার ব্যাপ্তি প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু হয় শাবিপ্রবিতে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যুগে এসেও আমাদের দেশে বাংলা ভাষার কোনো সার্চ ইঞ্জিন ছিল না। ২০১৩ সালে শাবিপ্রবিতে প্রথম বাংলা ভাষার অনুসন্ধান ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ যাত্রা শুরু করে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলা ভাষায় চালু হওয়া একমাত্র সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ সফলভাবে তথ্য সেবা প্রদান করে আসছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০২০ সালে ‘ডিজিটাল ক্যাম্পাস অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। তার আগে ২০১৭ সালে ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সমন্বিত সম্মান কোর্স চালু করার পাশাপাশি ১৯৯৬-৯৭ সেশন থেকে স্নাতক কোর্সে সেমিস্টার পদ্ধতির (আমেরিকান সেমিস্টার পদ্ধতি) প্রবর্তন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এসএমএসভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ভর্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ পদ্ধতির উদ্বোধন করেন। এ জন্য শাবিপ্রবি ২০১০ সালে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতায় Ambillion পুরস্কার, E-Content এ–জাতীয় পুরস্কার এবং উন্নয়নের জন্য আইসিটি পুরস্কার ২০১০ লাভ করেছে।
মাত্র কয়েক দশকে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে অর্জিত সব গুণাগুণের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে তোলে। তাই শাবিপ্রবিকে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলা যেতেই পারে। শাবিপ্রবির শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে পরম মমতায় আগলে রাখা গ্র্যাজুয়েটরা বের হয়ে আসে। দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেরা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। দেশের বাইরেও অতি সুনামের সঙ্গে বিচরণক্ষেত্র তৈরি করে নিচ্ছে। নিজেদের উদ্যম এবং অধ্যবসায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনের সারিতে এগিয়ে রাখে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘সাস্টিয়ান (SUSTIAN)’ পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত রেখেছে ‘সাস্টিয়ান’ হিসেবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চিরস্থায়ী এক আবেগময় বাঁধনে হবিগঞ্জে সাবেক শাবিপ্রবি ছাত্রদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘সাস্টিয়ান হবিগঞ্জ’। ‘সাস্টিয়ান হবিগঞ্জ’ অতি মানবিক কাজে উৎসাহী হয়ে অনন্য সব কাজ করে যাচ্ছে। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে করোনাকালে খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অকাল সময়ে মানবতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।
দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে সবুজের মিশেলে শাবিপ্রবির প্রাঙ্গণ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশদ্বারে এক কিলোমিটার সোজা রাস্তা সৌন্দর্যপিয়াসী মনকে আনন্দ দান করে। শাবিপ্রবির বিখ্যাত সেই এক কিলোমিটার রাস্তা ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে। পাহাড়–সবুজের সমারোহে শত সোপানবিশিষ্ট শহীদ মিনার সবার মন আকৃষ্ট করে। আর শাবিপ্রবির জন্মদিনে অর্থাৎ রাঙানো বসন্তের আগমনে পুরো ক্যাম্পাসটাই মুখরিত হয়ে ওঠে। যেন ক্যাম্পাসের আলিঙ্গনে উষ্ণতা ছড়িয়ে দুরাস্তার মাঝখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে নাগেশ্বর চাঁপার গাছগুলো।
তাই উজ্জ্বল আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠুক তোমার চিরচেনা ক্যাম্পাসটি। তোমার মাঝে শিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডারে যেন খুঁজে পায় প্রাণের পরশ। ভবিষ্যৎ শুভকামনা শাবিপ্রবি।
*অনজন কুমার রায়, সাবেক শিক্ষার্থী ও লেখক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়