শাটল বিড়ম্বনায় পাহাড়কন্যা চবি
প্রকৃতির মাঝে উন্মুক্ত বিচরণ, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে শৈল্পিক কারুকার্য শোভিত বহুতল ভবনে ব্যস্ততা, সেখানে দেখা মেলে হরেক রকমের পশুপাখি আর বন্য জন্তুর।
হয়তো ভাবতে পারেন কোনো এক সুসজ্জিত উন্মুক্ত চিড়িয়াখানায় আপনি স্বাধীন, পশুপাখিরাও আপনার মতোই। সেখানে মাথা উঁচু করে পাহাড়ের বুকে গজিয়ে ওঠা বৃক্ষরাজি ছাতার অবয়বে আপনাকে ছায়া দেবে। অরণ্যবেষ্টিত নৈসর্গিক পাহাড়গুলো শুধু যে বন্য জীব প্রজাতিকেই আশ্রয় দিয়েছে, তা কিন্তু নয় বরং যান্ত্রিকতা আর হাতুড়ি–কোদালে গড়ে উঠেছে মানুষের সভ্যতা। বুকের সেই ক্ষত সানন্দেই মেনে নিয়ে বসন্তে বারবার হেসে ওঠে পাহাড়গুলো। শুধু কি তাই, বুক উজাড় করে কাটা পাহাড়ের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ কোনো কালেই-বা মেনে নিয়েছে প্রকৃতি। শিক্ষার আলোসন্ধানী কর্মোদ্যম শিক্ষার্থীদের পায়চারিতে হেসে ওঠে তার রূপ। এ যেন উন্মুক্ত শিক্ষালয়।
সেখানে কখনো পাখির কিচিরমিচিরকে ছাপিয়ে বেজে ওঠে যন্ত্রের শব্দ। ব্যস্ততার শাটলের সুরে ঘুম ভাঙে ২১০০ একরের। ইট-পাথর আর যান্ত্রিকতার সঙ্গে প্রকৃতির এরূপ মেলবন্ধন পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রায় ৩০ হাজার তারুণ্যে মুখরিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাই দেশের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পাসের তকমাধারী, শাটলের সাইরেন বেজে ওঠা পৃথিবীর একমাত্র বিদ্যাপীঠ।
১৯৬৬ সালে যাত্রা করা স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি পেরিয়েছে ৫৫ বসন্ত। দেশকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে তার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকারের উপায় নেই। ৬৯–এর গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতাযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সমসাময়িক যত প্রেক্ষাপট রচিত হচ্ছে, তাতে মোটাদাগেই ইতিহাসের অংশ হয়ে রবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ভোগান্তি নিরূপণে ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীদের একমাত্র বাহন হিসেবে মহাকাব্যিক সব ঘটনার সাক্ষী হলেও শাটলেরই রয়েছে রক্তাক্ত হওয়ার ইতিহাস। সময়ের গতিধারায় বেড়েছে শিক্ষার্থীদের কলরব। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি শাটলের সংখ্যা। বগি সংখ্যা বাড়ানো বা ডেমু ট্রেনের শিডিউল নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। একবিংশ শতাব্দীর সময়ের মূল্যও বাড়াতে পারেনি শাটলের গতি।
সেখানে শিডিউল আটকে যাওয়া নিত্যকার ঘটনা। শাটলের গর্ব যেন পরিণত হয়েছে দুঃখবিলাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জানালেন দুর্ভোগের কথা। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেন প্রায় শিডিউলমতো না আসায় শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে পরীক্ষা বা ক্লাসে উপস্থিত হতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় শাটলের আসনসংখ্যা সীমিত হওয়ায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে আসা-যাওয়া করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফ মজুমদার আক্ষেপের সুরে বলেন, শাটল ট্রেনের পর্যাপ্তসংখ্যক বগির অভাবে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
প্রতিদিন ৯-১০ হাজার শিক্ষার্থী বাদুড় ঝোলা অবস্থায় যাতায়াত করেন শাটল ট্রেনের মাধ্যমে। যেখানে নিরাপত্তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। ট্রেনের বগিগুলো পুরোনো হওয়ায় জানালাগুলোও অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে পাথরের ঢিলে মাঝেমধ্যেই ঘটছে মাথা ফাটার মতো ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস সায়মা জানান, ‘ভর্তি হওয়ার সময় আমরা শাটল ট্রেন বাবদ ফি দিয়ে ভর্তি হই। কিন্তু বর্তমানে শাটল ট্রেন ঠিকমতো চালু না হওয়ায় আমাদের নিয়মিত শহর থেকে বাসের মাধ্যমে যাওয়া–আসা করতে হচ্ছে, যা যথেষ্ট ব্যয়বহুল।’
২০১৯ সালের জুলাই মাসে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে চড়ে ক্যাম্পাসে আসেন। এ সময় মন্ত্রী চবি রুটের রেললাইনের দুরবস্থার সমালোচনা করেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কারের নির্দেশ দেন। এরপর দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতি হলেও নতুন শাটলের দেখা মেলেনি চবি স্টেশনে। উল্টো শাটলের বগি সংখ্যা এবং ডেমুর শিডিউল কমে দুর্ভোগে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শুধু শাটলের বগি বা শিডিউল বাড়িয়ে নয়, শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একমাত্র যাতায়াত মাধ্যম রেলের আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি।
* লেখক: আকিজ মাহমুদ, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।