লকডাউনে পেট তো খিদা মানে না
করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি খাতই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন খাতগুলো হলো শিক্ষা, বাণিজ্য, পরিবহন, কৃষি, পর্যটনশিল্প ও হোটেল–বাণিজ্য ইত্যাদি। উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনুন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়।
করোনা মহামারিতে সারা দেশে চলছে সর্বাত্মক লকডাউন। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষ পড়েছে নিদারুণ কষ্টে। অর্থনৈতিক মহাসংকটে পড়তে হচ্ছে দিনমজুরদের। খেটেখুটে খাওয়া মানুষের এমনিতে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’, তার ওপরে যদি লকডাউনে কর্মহীন হয়, তবে তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করা দুটোই কষ্টসাধ্য।
লকডাউনে নেত্রকোনার কলমাকান্দার চত্রংপুর গ্রামের বাসিন্দা অটোরিকশাচালক মো. রফিক মিয়াকে দেখা গেল প্রতিদিনের মতো রিকশা নিয়ে বের না হয়ে অন্যের জমিতে ভাগে বোরো ধান কাটতে। রফিক মিয়াকে রিকশা চালানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ করতে কখনো দেখিনি। তাই অনেকটা উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করি,
-আরে রফিক, তুমি ধান কাটছ?
-রফিক উদাস কণ্ঠে বলে, কী করতাম ভাই! রিকশা নিয়া বাইর অইলে পুলিশে দাবড়ানি মারে। যাও একটু–আধটু পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়া চালাই, লকডাউনের কারণে যাত্রী পাই না। মানুষ তো ঘর থ্যাকে বাইর অয় না।
-তাই বুঝি আজ ধান কাটছ!
-দ্যাহেন ভাই, আমরা হইলাম গরিব মানুষ, গতরখাটা লোক। কাজকাম না করলে খাইতাম কী? পেট তো খিদা মানে না। এক দিন কাজ না করলে চুলায় আগুন জ্বলে না।
রফিক আবার একটু দম নিয়ে বলতে থাকে, জানেন ভাই, সমিতি থ্যাকে ঋণ নিয়া রিকশা কিনছি। প্রতিদিন ৩০০ ট্যাহা কিস্তি দিতে অয়। সংসার খরচা, ঔষধপত্তর, আরও কত–কী? এই দিকে রাইতে রিকশা চার্জের জন্য ঘরমালিককে ১০০ ট্যাহা ভাড়া গুনতে অয়। চার্জ হোউক না হোউক ঘরমালিকে ১০০ টাকা দিতেই অইব।
কয় দিন ধরে রাইতে ঝড়–তুফান হওয়ার ল্যাইগ্গা কারেন্ট আয় না। কারেন্ট না আইলে রিকশা চার্জ অয় না। চার্জ না অইলে চালাইতাম ক্যামনে?
-আহ এ যে দেখছি তোমার ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’।
-ভাই, কয় দিন থ্যাইক্কা মনডা খুবই খারাপ। বাচ্চা দুইডা ঘরে গেলেই বস্তু (বিস্কুট) খাইবার চায়। খুব করে ধরে। কয় বাবা বস্তু আনছ। বস্তু দেও। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাইলে কষ্টে বুকটা চৌচির হইয়া যায়।
-তাই আজ ধান কাটতে আসছ?
রফিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয়, এ ছাড়া করতাম কী? সরকার তো আমাদের জন্য কিচ্ছু করে না। আমি ধান কাটায় খুব বেশি সুবিদে করতাম পারি না। জন্মের পর থ্যাইক্কা এই এক কাম, রিকশা চালানো ছাড়া আর কিচ্ছুই ভালা কইরা পারি না। এহন বাধ্য হয়েই ধান কাটছি কয়ডা ট্যাহার আশায়।
-প্রতিদিন তোমার রিকশা চালিয়ে কত আয় হতো?
-এইডার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। একেক দিন একেক রকম। কোনো দিন ৫০০, কোনো দিন ৬০০ আবার কোনো দিন বেশিও অইত।
-আর এখন ধান কেটে প্রতিদিন কত পাবে?
-৭০০ ট্যাহার মতো। কিন্তু ধান কাটা যেমন তেমন এই গরমে মাথায় করে বুঝা টানাডা খুব কষ্টের। জীবনডা বাইর হইয়া যায় গরমে!
-আমার হইল মরণ! সমস্যা একটার পর একটা ল্যাইগ্গাই আছে। রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ থ্যাহে না। একটু চালাইলেই চার্জ শেষ! ব্যাটারি বদলাইতে অইব।
-কত লাগে?
-সে তো ম্যালা? এই ধরেন, ৪০ থেকে ৪৪ হাজার ট্যাহা।
-এত লাগে?
-হ ভাই।
-এত টাকা কই পাবে?
-এইডাই তো চিন্তা করছি, এত ট্যাহা পাইতাম কই?
-আমি যদি তোমাকে কিছু টাকা ধার দিই, তবে কি ব্যাটারি কিনতে পারবা? পরে না হয় আমাকে আস্তে আস্তে ধারের টাকাটা পরিশোধ করে দিলা।
-তাইলে তো ভালোই অয়। কিন্তু বাকি ট্যাহা ক্যামনে জোগাড় করতাম?
রফিকের সাহায্য করার আশ্বাস দিয়ে আমি বিদায় নিলাম। কিন্তু মোদ্দাকথা হলো, লকডাউনে যারা নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ, তারা এখন যাবে কোথায়, করবেটা কী, খাবেটা কী? সরকার তো এদের জন্য কোনো রকম ভর্তুকি বা অন্য কোনো সাহায্যের ব্যবস্থা করছে না। দেশের আপামর জনসাধারণের রয়েছে বহুবিধ সমস্যা। বর্তমানে বোরো ধান কাটার মৌসুম চলাতে অনেক শ্রমজীবী মানুষ কোনো রকম জীবন ধারণের তাগিদে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। কিন্তু সে সংখ্যাটাও সীমিত। সারা দেশের চিত্রটা ভিন্ন ও ভয়ংকর। শহর থেকে অনেক মানুষ এখন গ্রামে চলে আসছে। তারা এখন কর্মহীন। শহর ও গ্রামে লাখ লাখ মানুষ বেকার বসে আছে। এসব কেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের উচ্চবিত্তদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমজীবী মানুষদের বাদ দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ বাঁচলে আমাদের অর্থনীতি বাঁচবে এবং দেশ বাঁচবে। তাই আসুন মানবতার কল্যাণে—
সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই
দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াই,
লেখক: মো. মাহাবুবুর রহমান, উদ্যোক্তা।