লকডাউন নয়, জীবনের গতিই দিতে পারে টিকে থাকার সন্ধান

করোনাভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

দেশে করোনায় মৃত্যু ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ১০০ জনে পৌঁছেছে। ৭ লাখের ওপর সংক্রমণ। ১৪ এপ্রিল থেকে ৭ দিনের জন্য লকডাউন চলছে, সরকারি প্রজ্ঞাপনের ভাষায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ। শব্দের ভিন্নতা যা–ই থাকুক গণ-মানসে বিভ্রান্তি-বিস্ময়ের কোনো কমতি নেই। কঠোর লকডাউনের কোনো আলামত নেই সাধারণের চোখে। কলকারখানা, গার্মেন্টস, সীমিত পরিসর ও সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান-প্রতিষ্ঠান খোলা, বন্ধ গণপরিবহন, সাধারণ যানবাহন। ব্যাংক বন্ধ থাকবে বলা হলেও শেষ মুহূর্তে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে কেউ হাঁটে, কেউ ঘাটে আর সাধারণ জনগণ নিরুপায় নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘরে আটকা।

করোনা প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ওপর আস্থার জায়গাটি খুবই নড়বড়ে। করোনা সংক্রমণের প্রথম থেকে অব্যবস্থা এবং সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠেই চলছে। জাতির মননে স্বস্তির জায়গাটি কোনো দিনই সৃষ্টি হয়নি। জনগণের জন্য আশার কথা-ভরসার জায়গাটি সত্যি অধরা থাকছে।
করোনায় গত বছরের সরকারের মাঠ প্রশাসনকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। কিছু বিতর্কিত বিষয় ছাড় দিলে দেশের সব স্তরের চিকিৎসাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আনসার, পুলিশ, বিজিবি, সেনা ও নৌবাহিনী, সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাকর্মীদের জীবন বাজি রেখে কাজ করতে দেখা গেছে। অকাতর চিকিৎসা ও ত্রাণ সেবা দিতে গিয়ে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাখ্যাত বহুসংখ্যক যোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেছেন।

করোনা মোকাবিলায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের রেপিড কিট ও গ্লোব বায়োটের টিকা উদ্ভাবনের দাবির ঘোষণা ছিল আশাজাগানিয়া, যদিও দুটি উদ্ভাবনে ব্যাপক পরীক্ষাধীন অবস্থায় ছিল। বহুল প্রত্যাশিত উদ্ভাবন দুটি কোথায় হারিয়ে গেল, জনগণ জানে না। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী টিকার সংকট চলছে। কোনোটির কার্যকারিতা বা ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার প্রশ্নে বাতিলও হচ্ছে।

প্রতিনিয়ত ধরন পাল্টানো কোভিড-১৯ মানব বিনাশী এক আতঙ্ক। কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও কারও কারও ধারণা, করোনার প্রবল প্রভাব আরও ২-৩ বছর থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আভাস-ইঙ্গিতে বলছে, আমাদের জীবনের সঙ্গে করোনা মিলমিশ করে চলবে। অর্থাৎ স্থায়ী আতঙ্ক হিসেবে থাকছে। এমন শঙ্কার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রস্তুতি কী? করোনা মোকাবিলায় আমাদের কৌশল কী, জনগণ তা জানতে আগ্রহী।

করোনার অতিমারির থাবা থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পাব, সে প্রশ্নে যাওয়ার আগে আমাদের আর্থিক সামর্থ্যকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শ্রমনির্ভর, কৃষি-গার্মেন্টস ও প্রবাসীর অর্জননির্ভর। সাম্প্রতিককালে কৃষি থেকে খাদ্য নিরাপত্তা মোটামুটি নিশ্চিত থাকলেও দেশের অর্থনীতির নিয়ামক গার্মেন্টসশিল্প ও প্রবাসীর আয় করোনার প্রাদুর্ভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের অভ্যন্তরে শ্রমজীবী, প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক/কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সাধারণ জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে।

লকডাউন কঠোর করতে হলে সংকটে থাকা সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখতে হবে। ঘরে রাখা সম্ভব তাদের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে। সরকার ঘোষিত আড়াই হাজার টাকা করে মাসিক প্রণোদনা দিলে ১ মাসে ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকার বিষয়। যদি লকডাউন দীর্ঘ মেয়াদে করতে হয়, তবে কি দেশ সে ভার বহন করতে সক্ষম হবে? ঘাড়ে খড়্গ নিয়ে সরকার যদি তা করেও, তবে কি পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অবশিষ্ট থাকবে? বর্তমান সময়ে তা বাস্তবায়ন করা অনেকের মতে অসম্ভব। এ অবস্থায় ঢিলেঢালা লকডাউনের ভার দেশ আর বহন করতে পারে না।
ইতিমধ্যে বৈশাখী অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, দেশে রমজান মাস চলছে, এ পরিস্থিতিতে দেশ কি জোড়াতালির লকডাউনের মধ্যে থাকবে, নাকি জীবন-জীবিকা সমন্বয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে? পৃথিবী এখন করোনার ২য়-৩য় প্রবাহকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বয়ের পথে হাঁটছে। আমরা কী করব? অর্থনীতির দিকে তাকালে জীবনের প্রতি কিছুটা নিষ্ঠুর হওয়া ছাড়া আপাতত বিকল্প কিছু আছে অনেকে মনে করেন না।
করোনা প্রতিরোধে আমাদের গতানুগতিক কৌশলকে নতুন করে ঢেলে সাজানো উচিত। লকডাউনের কার্যকারিতা যেহেতু আশানুরূপ পর্যায়ে নেই, তাই তা প্রত্যাহার করে মানুষের জীবনের গতিকে ফিরিয়ে আনা উচিত। করোনাকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধের লক্ষ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে চিহ্নিত করা সময়ের দাবি। জীবনকে গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য দিতে কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো।

করণীয় কার্যক্রম

১. আক্রান্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ সব এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে গণ্যমান্য ব্যক্তি নিয়ে একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করতে হবে;
২. প্রতিটি খণ্ড এলাকায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ছোট আকারে স্বেচ্ছা সেবা কর্মী তালিকা প্রণয়ন করতে হবে, কাজের সুবিধার্থে বাসা/বাড়ি/বিল্ডিংয়ের প্রহরী/দারোয়ানকে স্বেচ্ছাসেবী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়;
৩. সংক্রমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ সব অঞ্চলকে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করে অধিবাসী/নাগরিক তালিকা প্রণয়ন করতে হবে;
৪. করোনা পজিটিভ রোগী ও পরিবারকে আলাদা করার লক্ষ্যে চিহ্নিত করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতি খণ্ডিত এলাকায় আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করতে হবে এবং গমনাগমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;
৫. আক্রান্ত এলাকার সব লোককে বিনা মূল্যে করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং আক্রান্ত রোগী ও পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, পথ্য, চিকিৎসা, সুরক্ষাসামগ্রী ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, অন্যদের লক্ষণ-উপসর্গের চিকিৎসা করতে হবে;
৬. স্বাস্থ্যসেবার স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে সব বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক ও এর কর্মরত ডাক্তার, নার্স সব পর্যায়ের স্টাফ এবং মেশিনারিজ চুক্তির মাধ্যমে আগামী ৩ মাসের জন্য সরকারের তত্ত্বাবধানে আনতে হবে, প্রয়োজনে সময় বৃদ্ধি করতে হবে;
৭. মাস্ক পরিধান, শারীরিক দূরত্ব বজায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণকে বাধ্য করতে হবে;
৮.স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনতিবিলম্বে খোলার ব্যবস্থা করতে হবে;
৯. সব ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অফিস–আদালতকে কঠোর নজরদারির আওতায় রাখতে হবে;
১০. শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের স্বার্থে সব ধরনের যানবাহন পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে।
আশা করি, উল্লিখিত প্রস্তাবনাটি বিবেচনার দাবি রাখে। এই বলে উপসংহারে আসতে পারি যে সরকারের দায়দায়িত্ব ও জনগণের কর্তব্য পালনই নাগরিকের জীবন ও অধিকার নিশ্চিত হতে পারে এবং জীবনের গতিই দিতে পারে জীবন টিকে থাকার সন্ধান।

লেখক: শেখ জহির উদ্দিন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠক, কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ।