রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে

ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বরাজনীতিতে পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর কূটনৈতিক অপতৎপরতার শিকার হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

চীন, রাশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক কারণে বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও এখন এটা গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। কারণ, কয়েকটা দেশ বা সংস্থা ছাড়া আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা বা মহল রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে জোরালোভাবে সমর্থন করছে না।

গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নৃশংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় একটি কাজ। ধীরে ধীরে পরাশক্তি দেশগুলো মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করলে একটা সমাধান হবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশে বর্তমান ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের কয়েকটি পয়েন্টে আশ্রিত আছে। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাহাড়ি আবাদি জমি ও পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজনও অনেক কষ্টে জীবন যাপন করছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে তাড়িত করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা বলেছিল মিয়ানমার। তবে সেই সংখ্যা কমে ৭০০–তে নামানো হয়েছে।

এই ৭০০ পরিবারের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা। কারণ, ৭০০ পরিবারের নামের তালিকা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সঙ্গে উদ্ভট শর্তও জুড়ে দিয়েছে। একটি পরিবারের ১০ সদস্যদের মধ্যে ১০ জনকেই নিতে হবে, এটা না করে সদস্যদের মধ্যে কারা যাবে বা কারা যাবে না, সেটাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে একটি পরিবার সেখানে ফিরে যেতে নিঃসন্দেহে অসম্মতি জানাবে।

মোটকথা, বাংলাদেশ কোন রোহিঙ্গা পরিবারকে পাঠাবে, সেটা বাংলাদেশ তালিকা করবে। মিয়ানমার কীভাবে সেই তালিকা পাঠায়? রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের পাঠানো ৭০০ পরিবারের তালিকা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও বলেছেন, ‘তালিকাটা এমনভাবে তৈরি করেছে, যাতে মনে হয়, তাদের সদিচ্ছার অভাব আছে। অন্য দুরভিসন্ধি আছে। আমার সহকর্মীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, এতে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। এরা যাতে না যায়, তার জন্য এ তালিকা দেওয়া হয়েছে।’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে লাখো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে গড়িমসি করবেই। কারণ, রোহিঙ্গাদের তো তারা তাদের দেশের নাগরিকই মনে করে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অস্বীকার করে বাঙালি বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। শত বছরের শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও অবদানকে অস্বীকার করে যারা গণহত্যা, জ্বালাও-পোড়াও করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে দিতে পারে, তারা ফেরত নিতে চাইবে না বা নেবে না এটাই স্বাভাবিক।

তাহলে সমস্যার সমাধান কোথায়? বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদর্শিক ভাবধারার পরিবর্তে বাস্তবতাভিত্তিক ভাবধারাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। রোহিঙ্গাদের যখন আশ্রয় দেওয়া হয়, তখন মানবতার খাতিরে ও আদর্শিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে আদর্শিক দিককে বেশি প্রাধান্য দিলে জাতীয় স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ উভয়ই ব্যাহত হয়। যেমনটি রোহিঙ্গাদের বেলায় আমাদের হয়েছে। সুতরাং, আমাদের উচিত বাস্তবতায় ফিরে আসা। আমরা জানি, ভূরাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রজেক্ট চীন ও রাশিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে গাঁট বাঁধা বলে আমরা চীন ও রাশিয়াকে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে বলতে পারি না।

তবে চীন ও রাশিয়ায় আমাদের কূটনীতিকদের এমন কিছু বার্তা দেওয়া দরকার, যেখানে আমরা ফুটিয়ে তুলতে পারব যে মিয়ানমার নয়, বরং বাংলাদেশকেই দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার। আমাদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড কোনো কিছুই চীন ও রাশিয়ার স্বার্থবিরোধী নয়। এ ছাড়া ওআইসির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে জোরালো জনমত তৈরি করতে হবে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে স্বার্থকেন্দ্রিক যেসব পরাশক্তির আঁতাত আছে, তাদেরও প্রভাবিত করতে হবে।

যত দূর সম্ভব সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আমাদের এ সমস্যা সমাধানের পথে আগাতে হবে। কারণ, কোনো কারণে কূটনৈতিক বিপর্যয় ঘটলে, সেটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের মতো ছোট ও শান্তিপূর্ণ দেশে কোনো অবস্থাতেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কাম্য নয়।

লেখক: মো. শফিকুল ইসলাম নিয়ামত, শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।