রবীন্দ্রনাথ বিহীন বাংলা সাহিত্যের আট দশক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অনেক লেখা আছে, থাকবে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নানা মানুষ লেখেন। লেখার কি শেষ আছে? রবীন্দ্রনাথকে মেলে ধরা সহজ কোনো কাজ নয়। তবু তাঁকে জেনে–বুঝে তাঁকে নিয়ে লিখতে চান, এমন মানুষের অভাব নেই। ৮০তম প্রয়াণ দিবসে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে তাঁকে নিয়ে লেখার চেষ্টা।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্য ভাবে সুগভীর, গীতিময়, চিত্ররূপময়, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহ্যপ্রীত। এতে রয়েছে অনাবিল প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বিপুল বৈচিত্র্য আর সেই সঙ্গে বাস্তব চেতনা ও প্রগতি। রবীন্দ্রনাথের গদ্যের ভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শনের প্রভাব তাঁর রচনায় গভীর। তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে। সমাজ কল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।
সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেব–দেবী গ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী ঈশ্বরের পূজার কথা বলতেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর রচিত—
‘আমার সোনার বাংলা...’ ও ‘জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে...’ গান দুটো বাংলাদেশ আর ভারতের জাতীয় সংগীত। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রতিভায় বহুমাত্রিক আর তাই কৃষ্ণা দত্ত ও এন্ড্রু রবিনসন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘বহুরূপী মানসের মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনদর্শনের একটি দিক ছিল, তিনি মনে করতেন তাঁর জীবনসাধনার মূলে ছিল গতিশীলতা। একটি আরম্ভ থেকে পরিবর্তনশীল গতিশীলতার ভেতর দিয়ে জানা–অজানার দিকে এগিয়ে যাওয়াই তাঁর জীবনদর্শন। যৌবনের সূচনা থেকেই জীবনের সব ক্ষেত্রে গতিরোধের পদচারণা। সংসারে সংযুক্ত থেকে সংসারকে দেখেছেন, আবার গতিচেতনায় এ সংসারের সান্নিধ্যও কঠিন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তাই তিনি লিখেছেন,
‘সংসারেতে দারুণ ব্যথা লাগায় যখন প্রাণে
আমি যে নাই, এই কথাটাই মনটা যেন জানে
যে আছে সে সকল কালের, একাল হতে ভিন্ন
তাহার গায়ে লাগে না তো কোনো ক্ষতের চিহ্ন।’
গতি ও সৃষ্টি সভ্যতার মূলমন্ত্র। এ গতির ধর্ম অব্যক্তকে ব্যক্ত করা, অপ্রকাশকে প্রকাশ করা। আমার মনে হয় সৃষ্টির প্রতিটি অণু–পরমাণু অভিব্যক্তির আবেগে নিত্য চঞ্চল৷ সৃষ্টির অংশ হিসেবে মানুষের তো একটাই পরিচয়, মানুষ। সৃষ্টি বৈচিত্র্যময়, বিচিত্র এই পৃথিবী, মানুষের জীবনটাও বৈচিত্র্যময়। মহান মানুষ যাঁরা, তাঁরা তাঁদের সাধনা ও জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করেন জীবনকে। জীবনের স্রোতধারায় সাধারণ মানুষ কচুরিপানার মতো। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ হতে পারে না, পারে না লিও তলস্টয়, শেক্সপিয়ার, আইনস্টাইন কিংবা সিগমন্ড ফ্রয়েড হতে। হন না ফ্রেডরিখ নিৎসে, বার্টান্ড রাসেল, ভলতেয়ার, কার্ল স্যাগান, চার্লস ডারউইন অথবা গ্যাঁটে, কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা আরও অনেকের মতো। মহান মানুষেরা সমাজের বেশ কিছু কলুষিত নিয়মের গণ্ডির বাইরে থেকেছেন বা থাকেন। তাঁরাই করেছেন বড় বড় আবিষ্কার, বদলেছেন সমাজ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। তিনি ছিলেন সমগ্র মানবসমাজের কর্মচারী। কোনো মানুষই নিজের জীবনের এই উদ্দেশ্য ও ফলের কথা ভাবেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টিই তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ কীর্তি। সহস্র বাধা অতিক্রম করেও কোনো কিছুর তাড়নায় তিনি লিখেছেন। মানুষের যে সৃষ্টি, তা অন্য এক শক্তিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজের ভাষায় বলেছেন, ‘মূলে আমার কথা ও তাহার কথা এক’। এটা এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর সৃষ্টি অর্থাৎ তাঁর কীর্তিই স্থায়ী হয়ে আছে। তিনিই নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি অমর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের অন্তরে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
*লেখক: তারেক তানভীর, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।