যে হাসি ভুলবার নয়
ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টার আশপাশ। প্রতিদিনের মতো সেদিনও রাতে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। চারদিকে কোলাহল শোনা যাচ্ছে। আর পথচারীরা যে যার মতো গন্তব্যে ছুটে চলেছে। কেউবা নিজের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার, কিন্তু মিটমিট করে আকাশে চাঁদ হাসছে। দেখা যাচ্ছে তারার মেলা।
কিন্তু কেউ অপেক্ষারত সেই মানুষের খোঁজ নিচ্ছে না। কেউ তাঁর জন্য একমুঠো খাবারের কথা বলছে না। বৃদ্ধার মতো আরও অনেককে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা অপেক্ষা করেছেন খাবারের জন্য।
ঘটনাস্থল দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলস্টেশন। প্রতিদিনের মতো সেদিনেও পার্বতীপুর রেলস্টেশনে এসেছি। হঠাৎ চোখে পড়ল সেই বৃদ্ধকে। নেই তাঁর ঠিকানা, নেই তাঁর পরিবার–পরিজন। কেউ বলতে পারছে না তাঁর নাম। কেউ খোঁজ নেয় না তাঁর। পেট ভরে খেতেও পারেন না তিনি। প্রতিদিন একবার খাবার খান, অনাহারেও মাঝেমধ্যে কাটাতে হয়।
এ দৃশ্য দেখতে দেখতে সেখানে উপস্থিত হলো একদল তরুণ। তাঁদের হাতে খাবারের প্যাকেট। এক–দুটি নয়, অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট। সেগুলো তাঁরা বিতরণ করছেন ওই সব ব্যক্তিদের মধ্যে, যাঁরা একটু আগে এখানে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
জানা গেল, তাঁরা প্রতিদিন এখানে আসেন। রেলস্টেশনে পড়ে থাকা অসহায় ব্যক্তি, পথশিশু এবং না খেয়ে থাকা ব্যক্তিদের খাবার বিতরণ করেন। তাঁদের এ কার্যক্রমের বয়স প্রায় এক বছর।
করোনা পরিস্থিতিতেও তাঁদের শততম দিনে এভাবেই শহরে ঘুরে ঘুরে অসহায় মানুষের মধ্যে খাবার বিলি করছেন তাঁরা। তাঁদের একটি সংগঠন আছে। নাম ‘হ্যালো পার্বতীপুর’। এ সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের পকেট খরচের টাকা সাশ্রয়ের মাধ্যমে নিজেরাই পুঁজি তৈরি করেন। এই স্বল্প পুঁজি নিয়েই তাঁরা অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। প্রতিদিন আর্থিক অসংগতি থাকা মানুষের জন্য একবেলা সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করার ক্ষুদ্র এ প্রয়াস শুরু হয় হ্যালো পার্বতীপুরের মাধ্যমে।
তাঁরা নিজেরাই বাজার করেন, নিজেরাই রান্না করেন খাবার। এরপর সেগুলো নিয়ে যান তাঁদের নির্দিষ্ট জায়গায়। তাঁদের রান্না করা খাবার এখন পরিতৃপ্তি জোগাতে অনেকটাই সক্ষম। পার্বতীপুরে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা কম নয়। তবে স্বল্প পরিসরে হলেও শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা এসব ছিন্নমূল মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে সংগঠনটি। আর অর্থের জোগানের পুরোটাই আসছে তাঁদের পকেট খরচ থেকে।
হ্যালো পার্বতীপুরের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে গরিব-অসহায়, ছিন্নমূল মানুষের খাবারের কষ্ট বেড়ে গেছে। এতে আমাদের এখানে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমাদের এই উদ্যোগ যেন কিছু মানুষকে হলেও মাসে অন্তত এক দিন ভালো খাবার দিতে পারে। পাঁচ মাস ধরে আমরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এর পুরো টাকা আসে আমাদের পকেট খরচ থেকে। প্রতি মাসের পকেট খরচ থেকে কিছু অংশ আমরা সঞ্চয় করি। পরের মাসের শুরুতে সে টাকা একত্র করা হয়। সংগঠনের সদস্যদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকেরা এসব খাবার বিতরণ করেন। এতে খাবার পেয়ে ছিন্নমূল মানুষেরা খুবই খুশি।’
হ্যালো পার্বতীপুরের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত কুমার বলেন, ‘সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিরা যে যাঁর মতো মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আমরাও চেষ্টা করছি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আমরা সংগঠনের এই সদস্যরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে চেষ্টা করছি প্রতিদিন রান্না করে খাবার বিতরণের। আমাদের ইচ্ছা আছে এই ক্রান্তিকাল কেটে না যাওয়া পর্যন্ত এভাবে এসব মানুষের পাশে দাঁড়াবার।’
লেখা: আসমাউল মুত্তাকিন, শিক্ষার্থী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়