মধ্যবিত্তের পাশে দাঁড়াই বন্ধু হয়ে
কোন ঘাটে ভিড়বে করোনার তরি, কেউ তা জানি না। ৫ এপ্রিল থেকে আবার শুরু হয়েছে এক সপ্তাহের লকডাউন। ২০২০ সালে করোনায় ঢাকা শহর ছেড়েছে লাখো মানুষ। তাঁদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন গ্রামে গিয়ে। কেউ কেউ এ শহরে নামে মাত্র খেয়েপরে জীবনধারণ করছেন। মধ্যবিত্তরা লজ্জায় হাত পাততে পারেন না। আর কার কাছেই–বা তাঁরা হাত পাতবেন, বলুন। মধ্যবিত্তরা তো উচ্চবিত্তের বন্ধু হয় না, কাজেই বন্ধু ছাড়া আর কোনো কাছের মানুষের কাছে কি ধারদেনা করা যায়?
বাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। আমার প্রশ্ন, কেন? বাসমালিকেরা গরিব নাকি সাধারাণ যাত্রী—কাদের জীবন বেশি দায়গ্রস্ত? তারপর হচ্ছে শিল্পচর্চা, মানে অনেক ভরা পেটের মানুষের ভাষায় প্রাণের বইমেলা, আহারে বইমেলা! যেখানে নিয়মনীতির বালাই নেই। আমার কথা, এসব প্রকাশকেরা কি ভাতের অভাবে না খেয়ে মারা যেতেন? দিব্যি অনলাইনে বইমেলাটা চালিয়ে নিতে পারতেন। করোনা আবার আগ্রাসীরূপে ফিরল কেন? আমরা শিক্ষিতরা কি সচেতন? বিয়ে পার্টি বা আনন্দ–উৎসব কোনোটাই কি থেমে ছিল একটুখানি নতুন স্বাভাবিক জীবনের গন্ধ পেয়ে?
কাল অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে অনেক কথা হলো। সেই কথা বা গল্পের মূল সারমর্ম ছিল, আমাদের নিজেদের রোজকার জীবন। কীভাবে পার করছি আমাদের প্রাত্যহিক জীবন। কমবেশি সবাই যে যার বাসা ছেড়ে কোনোমতে একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন নামে মাত্র টাকায়। অনেকেই দুশ্চিন্তায় আছেন, না জানি কখন চলে যেতে হয় অবৈতনিক ছুটিতে। এক সহকর্মী দুঃখ করে বলছিলেন, আপা, মা–বাবাকে দেখব কি, নিজের বউ–বাচ্চার ভরণপোষণ করতে পারছি না! বরং মা–বাবার কাছ থেকেই হাত পেতে টাকা নিতে হচ্ছে। এ যে কি লজ্জার! তাহলে কেন একটা ভালো বিষয়ে নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করলাম, বলেন? এর কোনো উত্তর হয়, হয় না। কারণ, পুরো পৃথিবী আজ ভয়ংকর অবস্থায় পতিত। মিডিয়ার বন্ধুদের অবস্থা আরও করুণ। তাদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করলে মনে হয়, অন্তত খেয়েপরে তো বেঁচে আছি।
এই যদি হয় শিক্ষিত চাকরিজীবীদের অবস্থা, তাহলে যাঁরা রোজকার কামলা, যাঁরা রাস্তায় রিকশা চালান, যাঁরা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজেন, যাঁরা পথের মোড়ে টংদোকানে চা বেচে কোনোমতে দিন গুজরান, তাঁরা কোথায় যাবেন? ২০২০–এর করোনায় নিম্নবিত্তদের কথা বাদই দিলাম, মধ্যবিত্তদের যতটুকু যা জমানো ছিল, তার সবটুকু শেষ। অথচ মজার বিষয় হলো মালিকেরা মালিকই রয়ে গেছেন, এমনকি এ করোনায় বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যাও। কাজেই এবার বোধ হয় সময় এসেছে মধ্যবিত্তের ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ানোর।
হয়তো সরকার গরিব–অসহায় ব্যক্তিদের জন্য চাল–ডাল–তেল–নুন অনুদান দেবে, কিন্তু সেসবের কিছু অংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো অংশ তো রাঘববোয়ালদের খাটের তলায় মজুত হবে। তাহলে করোনা কী করে যাবে, বলুন? ঈমান মজবুত না হলে নৈতিকতা–বিবেকবোধ জাগ্রত না হলে বারবার আমরা মধ্যবিত্তরা মার খেয়েই যাব। কিচ্ছু হবে না ঘুনে ধরা অন্ধ সমাজের টাকাওয়ালাদের। দেখুন, গণমাধ্যমে আজ কদিন শুধু দেশে করোনায় কতজন আক্রান্ত হলেন আর কয়জন মারা গেলেন, এটাই শিরোনাম হচ্ছে। কিন্তু এই কদিনে বোধ হয় দেশের বিশেষ মানুষ রূপে পরিচিত কোনো ধনেকুবের করোনায় মারা যাননি। কাজেই ওইভাবে কাগজে বা মিডিয়ায় শিরোনামও আসেনি। আমাদের মতো সাধারণের মৃত্যু নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। কাজেই যতক্ষণ বিবেকের দরজা–জানালা খুলে বিশুদ্ধ বাতাস না ছড়াচ্ছেন, ততক্ষণ অবধি এ মহামারি অন্তহীন অপেক্ষার মতো রয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। শুভ হোক সবার, মঙ্গল হোক জাগতিক মানুষের।
*রোজিনা রাখী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
**নাগরিক সংবাদে [email protected] এ লেখা পাঠাতে পারেন