ভোরের ঘুম

আজ ঘুম ভাঙতেই আমি অবাক। আমার সঙ্গে আজ এখনো শুইয়ে আছে মা। কী ভাবছেন অবাক হচ্ছি কেন? একটু পরে বলি...
একটু হেঁটে দরজার বাইরে তাকাই আর অবাক হয়ে যাই। কী অপরূপ দৃশ্য! গাছে গাছে কত রংবেরঙের ফুল, পাখিদের ডাক আর আবছা ধোঁয়াশা আকাশ। কতজনের এই সৌভাগ্য হয় দেখার? আজ আমার হয়েছে। কেন জানেন? কারণ, আমি আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। মহামারি শুরু হওয়ার পর তো ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠাই হয় না। রাত জেগে কাজ করা, পড়ালেখা, আঁকাআঁকি, মুভি দেখা এসব হয়ে থাকে। আর সকালবেলা আরামের ঘুম। শুধু আমি কেন, অনেকেই হয়তো তাই করেন, আমি তো একা দোষী না! এমনিতেও ভোরের ঘুমটা আমার অনেক ভালো লাগে, যদিও ভোরবেলার এসব কিছু আমি খুব মিস করি। আমার মনে হয় দিনের শুরুটা যদি হয় পছন্দের, তাহলে দিন শেষটাও ভালো লাগে, ক্লান্তি অনুভব কম হয়। শুধু আমি না, এমন অনেকেই আছে আমারই মতো যেমন—
অফিস কর্মীদের কথা বলি...হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই যদি দেখে ৮টা বাজার আরও ১৫ মিনিট বাকি, মানে অনেক সময়। ওরা ভাবে—
‘ঠিক আছে, আরও ১০ মিনিট ঘুমিয়ে নিই। তারপর ৫ মিনিটে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ব। রোবটের মতো কাজ করব।’

ভালো কথা...উঠে যখন দেখে ৮টা ৫ বাজে...বোঝেন তখন ওদের অবস্থাটা কী হয়? সত্যিই তখন কিন্তু ওরা মানুষ রোবট হয়ে যায়। হাতে টুথব্রাশ নিয়ে টয়লেটে ঢুকবে...খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু হতে হবে। ও...ওদের আবার সকালের জগিংটা এখানেই হয়ে যায় বলতে পারেন, আবার ওদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও কম...ভালো ব্যায়ামও হয়।

বাহ, ব্যাপারটা ভালোই। যাহোক...রোবট মানুষগুলোর কাছে আবার ফিরে যাই...এরপর আবার যখন স্নান সেরে আসে তখন দেখা যায় কানের নিচে সাবানের ফেনা রয়ে যায়, চুল থেকে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে, টি–শার্টটা হাফ ভেজা। আহা রে মানুষ রোবটগুলোর কী একটা অবস্থা! এরপর কোনোমতে প্যান্টটা পরে হাতে কোট নিয়ে শু পরে সুপারম্যানের মতো দৌড়। শুটা পরিষ্কার না হয় এই দিন না–ই করা হলো। আবার চুল আঁচড়ানোর জন্য কিন্তু চিরুনির দরকার হয় না তখন। হাতই যথেষ্ট। আমার কাছে আবার এই জিনিসটা ভালোই লাগে, হাতের আঙুলগুলো অনেকটা চিরুনির মতোই।

চিরুনিতে যেমন দুই কাঁটার মাঝখানে ফাঁক থাকে, তেমনি হাতের আঙুলগুলোর মাঝখানটা ফাঁক। ভালোই চিরুনির মতো চুল আঁচড়ানো যায়। যাহোক ওদের কিন্তু ওই দিনের ব্রেকফাস্টটাও করা হয় না। রোবট মানুষগুলো ঘুমিয়েই পেট ভরে নেয়।

আর যাদের বউ আছে, ওই বেচারিদের কথা কী আর বলব...কত কষ্ট করে ভোরের ঘুম নষ্ট করে তাদের স্বামীর জন্য ব্রেকফাস্ট বানায়। কী আর করার তাদের রোবট স্বামীর খাওয়ার সময়টা আসলে হয় না। রোবট মানুষগুলো কিন্তু আবার ভাবে যে দিনের ২৪ ঘণ্টাকে যদি ২৫ ঘণ্টা করা যেত, তাহলে ওদের জন্য আরেকটু ভালো হতো।

রিলাক্সমতো একটু খাওয়াও যেত। যাহোক... তারপর বাসে করে যখন অফিস যায়, আর বাসটা খুব ধীরগতিতে চলে...ওদের মনে হয় পিটিয়ে মেরে চালকটাকে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে যদি নিজে তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালানো যেত! কিন্তু কী আর করার। যেভাবে আছে ওই ভাবেই থাকতে হবে। এভাবেই কি প্রতিটা দিন চলে? আবার ছুটির দিনে হাতে চা নিয়ে এসব ভাবতে খুব মজাই পায় কিন্তু তারা।

আমার আবার কিন্তু অনেকটা অসুবিধাও আছে। দিনের শুরু লেটে হয় তো কাজগুলোও লেটে হয়। আমার মা যখন ৯টা বাজতে দেখে আর আমি এখনো বিছানায় তখন জননী আমার, ‘আমি আসলে আজকে শেষ ঘুমটা পাড়িয়ে দিব’ ভয়ে আমি কোনোমতে হোঁচট খেয়ে উঠি। একদিন মা ব্রেকফাস্টটা দিতে দেরিই করল। আমি জিজ্ঞেস করাতে...
—আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে
—মা...আমি যদি আজ তোমার আগে উঠতাম
ভালোই হতো।

—কী ভালো হতো? কোনো মহাভারত রচনা করতি?
—আরে, আমি মা আর তুমি আমার মেয়ে হয়ে যেতে কী ভালোই না হতো? আমিও তোমায় বকাবকি করতে পারতাম। আমিও তোমায় বলতাম...আমি আসলে আজকে...না থাক আমার মুখ থেকে এগুলো বের হয় না। ওইগুলো তোমার মুখেই মানায়...।

—থাপ্পড়টা না খেতে চুপ করে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।
আমি তো চুপ হয়ে গেলাম। কারণ, আমার ওই সৌভাগ্য হবেও না কখনো। ভোরের ঘুমটা সত্যিই আমার খুব পছন্দের। আর বিরক্ত লাগে যখন ভোরবেলায় সূর্যের আলোটা আমার চোখে এসে পড়ে। আমিও পর্দায় একটান মেরে আলোটা কমিয়ে নিই। আবার ভোরবেলায় কাকের ডাক শোনা যায়। তখন নাহ ইচ্ছা করে কাকের মুখটায় স্কচটেপ মেরে আসি। তা তো পারি না। কিন্তু চোখের সামনে যখন আরামের বালিশটা দেখতে পাই, তখন কানের ওপর বালিশটা চেপে শান্তির ঘুম ঘুমাই।

আমার মতো অনেকেরই কিন্তু ভোরের ঘুম নিয়ে অনেক গল্প আছে। সুতরাং আমি একা কিন্তু আসামি না। আসলে ভোরের সবকিছুই আমার খুব ভালো লাগে। ভোরের স্বপ্ন, পাখিদের ডাক, ধোঁয়াশা আকাশ, মায়ের বকা, ভোরবেলার গান, চা—সবকিছুই আমার দারুণ লাগে। আর ভোরবেলায় সবার মনটাও ফ্রেশ থাকে। সবকিছুর থেকে ঘুমটাই বেশ লাগে।