ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে করণীয়

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

অর্থের বিনিময়ে মানসম্পন্ন, নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য ও সেবা পাওয়া প্রত্যেক ভোক্তার অধিকার। ভোক্তা অধিকার বর্তমান সময়ের আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভোক্তা হলো কোনো ব্যক্তি, যিনি তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ বা প্রয়োজনে পণ্যসামগ্রী বা সেবা ক্রয় করেন এবং তা নিঃশেষ করেন। অর্থাৎ, যেসব ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি কোনো বিক্রেতা থেকে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন এবং সেই পণ্য বা সেবার উপযোগ নিঃশেষ করেন, তাঁকে ভোক্তা বলা হয়।

একটি দেশে নাগরিকদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য রাষ্ট্র নাগরিকদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করে থাকে, যেগুলোকে বলা হয় নাগরিক অধিকার। আর এ নাগরিক অধিকারগুলোর মধ্যে ভোক্তা অধিকার অন্যতম‌। ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ১৯৮৩ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মুজিব বর্ষে শপথ করি, প্লাস্টিক দূষণ রোধ করি’।

জীবনের নিরাপত্তার জন্য একজন ভোক্তার অধিকার রয়েছে তাঁর প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবাটি  যথাযথ, সঠিকভাবে, সঠিক মাপে এবং সঠিক মানে পাওয়ার। পণ্য বা সেবার নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে সে পণ্য বা সেবা পাওয়া ভোক্তার অধিকার। তাই পণ্যের উপাদান, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, বিক্রয়মূল্য, পণ্যের মান, পণ্যের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানার অধিকার একজন ভোক্তার রয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবে এসব প্রশ্নের জবাব দিতে একজন বিক্রেতা বাধ্য। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ভোক্তা অধিকার ৮টি। এগুলো হলো: এক. মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, দুই. তথ্য পাওয়ার অধিকার, তিন. নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, চার. পছন্দের অধিকার, পাঁচ. জানার অধিকার, ছয়. অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, সাত. ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, আট. সুস্থ পরিবেশের অধিকার।

পণ্য বা সেবা ক্রয় করে প্রতারিত হওয়ার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে সরকার ২০০৯ সালে প্রণয়ন করে বহুল প্রতীক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’। এ আইন প্রণয়নের ফলে কোনো ভোক্তার পণ্য বা সেবা ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, বিক্রয়মূল্য, উপাদান, পণ্যের মান, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যের কার্যকারিতাসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই ভোক্তা অধিকার–সম্পর্কিত যে ভোক্তাবান্ধব গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন দেশে রয়েছে, সে সম্পর্কে জানে না। ফলে ভোক্তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে‌ন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অনলাইন কেনাকাটা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন আর লোভনীয় অফার দেখে ভোক্তারা পণ্য কিনে নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, বিশেষ করে চাহিদা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ না করা এবং করলেও নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করার ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটে চলছে।

পণ্য কিনে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ অনুসারে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৮২টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ধারার উপধারাও রয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু ধারা তুলে ধরছি।

আলোচিত প্রতিটি অপরাধের জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এবং জেল-জরিমানা করাও হচ্ছে। কিন্তু অপরাধের তুলনায় যে জেল-জরিমানা করা হয়, তা অতি নগণ্য। আবার এটাও বাস্তব যে অনেক খুচরা ব্যবসায়ী জানেনও না যে পণ্যের গায়ে পণ্যের উপাদান, বিক্রয়মূল্য, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যের কার্যকারিতা, পণ্যের মান ইত্যাদি লেখা না থাকা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পণ্য বা সেবা কিনে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অভিযোগ দায়ের করা অত্যন্ত সহজ। গুগল প্লে-স্টোরে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ কেন্দ্র’ অ্যাপসের মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায়। তা ছাড়া ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ ও ০৩১-৭৪১২১২ নম্বরে‌ ফোন‌ দিয়েও অভিযোগ করা যাবে।

এরপর তদন্ত শেষে অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে যে পরিমাণ আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া হবে। তবে শর্ত হচ্ছে, অভিযোগটি পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ৩০ দিনের মধ্যে দায়ের করতে হবে।

পণ্য কিনে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন বলে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন রয়েছে, সেটার কথা দেশের অধিকাংশ মানুষই জানে না। কিন্তু এর পেছনে কারণ কী? প্রধান কারণ হলো, এ আইনের প্রচার-প্রচারণার অভাব। তাই দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ একটা অংশ এ আইন সম্পর্কে জানে না।

তাই জনস্বার্থে এ আইনের প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণকে এ আইন সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, পণ্য কেনাকাটায় সচেতন করতে হবে। সর্বোপরি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভেজালমুক্ত পণ্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক: ইমরান ইমন, শিক্ষার্থী