ভাষার প্রকৃত স্বাদ

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সেকেন্ড মিনিট হয়, মিনিট ঘণ্টা। পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্যটি প্রভাতবেলা উষা হয়ে উঠলেই শুরু হয় আনকোরা একটি দিনের। আর সেই দিন পেরিয়ে আসে বছর। বছর ঘুরে আবারও দেখতে দেখতে চলে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। শীতের তিক্ততা কাটিয়ে ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। পত্রপল্লবে ভরে উঠেছে গাছপালা। সদ্য ফোটা আমের মুকুলে মৌ মৌ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃষ্ণার্ত মৌমাছির লোভাতুর দল। শিমুলের আগায় বসে করুণ সুরে বাজছে কোকিলের করুণ সুর। যে সুরে ভেসে আসছে বাঙালি জাতির আরেকটি আত্মত্যাগের কথা, সেই সঙ্গে গৌরবেরও। প্রকৃতির এই স্নিগ্ধ হাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে মাতৃভাষার প্রতি ভাষাসৈনিকদের অবদানের কথা।

১৯৫২ সালের এই মাসে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঘাতকের বুলেটে রাজপথ হয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে রঞ্জিত। সেই সূর্যসন্তানদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ ডিঙিয়ে আজ আমরা কথা বলছি মায়ের ভাষা বাংলায়। গান করছি বাংলায়, লিখছি বাংলায়, খাচ্ছি বাংলায়। মায়ের মুখের ভাষায় কথা বলার জন্য যে প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়, সারা বিশ্বে শুধু বাঙালি জাতি ছাড়া আর কেউ জানেই না। এ দিক দিয়ে অবশ্য জাতিসংঘের ইউনেসকো আমাদের সূর্যসন্তানদের আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করেননি। ইউনেসকো ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে ১৮৮টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে যথাযথ মর্যাদায়। জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগকে সারা বিশ্বে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

ভাষা শহীদদের স্মরণে দেয়ালে আঁকা হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের চিত্র। এক শিশুকে দেয়ালে আঁকা সেই চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তার মা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ইউনেসকোর বদৌলতে আজ গোটা বিশ্ব ভাষার জন্য বাঙালি জাতির অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। হোক না তা নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে। গোটা বিশ্ব আজ জেনে গেছে ভাষার জন্য একমাত্র বাঙালি জাতিই দিয়েছিল প্রাণ। দেখতে দেখতে চলে এল সেই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকা শহীদ মিনারগুলোতে ধোয়ামোছার কাজ চলছে। আর মাত্র কটা রাত ফুরিয়ে দিন হলে আমরা খালি পায়ে ফুল হাতে ছুটে যাব সেই চকচকে শহীদ মিনারে। বেদিতে উঠে নিবেদন করব দীর্ঘ এক বছর ধরে জমিয়ে রাখা বুক ভরা শ্রদ্ধা। আবার শুরু হবে বড় বড় বিপণিবিতানগুলোতে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা সাইনবোর্ড থেকে বিভিন্ন ইংরেজি নাম মুছে ফেলার তোড়জোড়। কালো কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে সব ইংরেজি! নাম না জানা ভাষা বিশারদদের মুখে ফুটে উঠবে বাংলা বুলি। ভাষার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে নানা বিশেষজ্ঞের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ‘টক শো’ প্রাঙ্গণ। মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে করা হবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। আর সেই অনুষ্ঠানে গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে ভাষাসৈনিকদের বরণ করে নেওয়া হবে সযতনে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করতে রায় দেবেন মহামান্য আদালত। আর সেই রায় নিশ্চিত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর তা দেখে অগোচরে কাঁদবে আমাদের মায়ের ভাষা ‘বাংলা’। কিন্তু ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি চলে যাওয়ার পর আমরা আবারও মেতে উঠব ভিনদেশি কোনো এক ভাষায়। যে ভাষার সঙ্গে নেই কোনো আত্মার আত্মিক বন্ধন কিংবা রক্তের টান। যে ভাষা আমাদের দিতে পারে না ভাষার প্রকৃত স্বাদ বা তৃপ্তি কিংবা মায়ের মমতা। এদিক দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার এক দেশ আমাদের মাতৃভাষাকে সম্মানের সঙ্গে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দেখিয়ে দিল বাংলা ভাষা কত যে শ্রদ্ধা আর সম্মানের।

লেখক: হিমু চন্দ্র শীল, শিক্ষার্থী—কক্সবাজার সরকারি কলেজ