‘ভালোবাসার রকমফের’ কল্পনার রাজ্যে বাস্তবতার বসবাস কতটুকু
‘ভালোবাসা’ শব্দটির অর্থ অনেক গভীর। ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবী অচল। দরদ দিয়ে দেখলেই কেবল সে জায়গায় উর্বরতা আসে। না হলে অযত্নে হারিয়ে যায়, শুকিয়ে যায় ভালোবাসাহীন বৃক্ষ। ভালোবাসার গুণেই প্রভুকে পাওয়া যায়। মানুষ আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হয়। জ্ঞান–মেধার চর্চা ভালোবাসা ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।
যে ভালোবাসা জীবনকে সুন্দর করে, সেই ভালোবাসাকে মানুষ কেমন করে কলুষিত করে কুরুচির পরিচয় দেয়? আত্মবিশ্বাস না লোভ—কোনটা? মানুষমাত্রই একজন বিশ্বস্ত সহচরনির্ভর। যে সহচর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে, ভালোমন্দের দেখাশোনা করবে। ভালো থাকার লোভ কার নেই? আমারও প্রচণ্ড রকম আছে। আপনারও একই। কেউ ভালোবাসাহীন থাকতে চায় না। ভালোবাসা ছাড়া জীবন মরা কাঠের মতো।
প্রেম–ভালোবাসা মানেই স্বর্গীয় সুগন্ধির ফুলেল সুবাস। কেউ যদি তা এড়িয়ে যেতে পারে, বলব মিথ্যা বলছে। সত্যিকার কারও ভালোবাসা যদি হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তবে তা ক্ষণিকের জন্য হলেও সত্য ছিল। আত্মার সঙ্গে আত্মার মিল ঐশ্বরিক বিষয়। তবে সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলোও যদি অতিশয় নির্ভরতার, জুতসই কমফোর্ট জোনের হয়, তাহলে তো নিজেকে বিলিয়ে দিতে বাধা নেই! ভুলটি ঠিক এখানেই। একটি বীজ রোপণ করার পর ফল দেওয়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করার সেই ধৈর্য মানুষের যেন আজ নেই। বয়সের তাড়নায়, রঙিন স্বপ্ন, ভালো থাকার গ্যারান্টি ফেলে যে কেউ সেই ফাঁদে পা দেবেই। খুব কম মানুষই অলৌকিক কিছু না ঘটলে ভেতরের খবর জানতে পারে না। বুঝতে পারে না অদূর ভবিষ্যতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। অযথাই আমরা মানুষকে দোষারোপ করি।
কেউ যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তখন আশপাশ আর ভাবে আসে না। আবেগ এতটাই কাজ করে যে বাস্তবতা হয়ে যায় কল্পনা আর কল্পনা হয় বাস্তব, যেন হাতের নাগালে। প্রেমের সুখের এ এক অন্য রকম অনুভূতি। মুহূর্তেই বদলে দেয় পরিবেশ, উথালপাতাল ভাবনার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ জন্যই এখনো প্রেম করছে মানুষ মানুষের সঙ্গে। মারামারি, ধরাধরি, মেনে নেওয়া না নেওয়ার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে মানবজীবনে। অথচ আমরা সবাই আদম সন্তান। এক জায়গা থেকেই সবার উৎপত্তি।
ধনী–গরিব দেখে প্রেম হয় না। মনের সঙ্গে মনের মিল, কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনে মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি প্রেম জাগায়। আমরা জিকির করি কেন? ইবাদত করি কেন? কেউ কি আমাদের পাহারা দেয়? আসলে ভালোবাসা যার যত বেশি, তার প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকা স্বাভাবিক বৈকি। অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সব খারাপ বন্ধ সম্ভব। অথচ আমরা চলছি ভিন্ন রথে, মূর্খের পথে। ভালো লাগা, ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। নোংরা হচ্ছে চাহিদা নির্ধারণের কারণে। জগতের এমন কিছু আছে, যা অসম্পূর্ণ সৃষ্টি? যৌক্তিক উন্নয়ন ঘটছে না কেন তবে মানুষের মনের জগতে? কেন দাপটের তোড়ে আরেকটি সৃষ্টিকে পুরোদস্তুর বেইজ্জতির জীবন দান করছি আমরা? মানুষ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি—তা কি তবে অমূলক প্রমাণ করছে মানুষ? এটাও কি সম্ভব? পাপের বোঝাই ভারী হয়ে গেছে। এবার তো যেতেই হবে। তবু কি আমরা পবিত্র ভালোবাসার নামে নোংরামি করে যাব? লোভের বাটখারায়, চাহিদা মেটাতে ভালোবাসাকে তুরুপের তাস বানাব? তবে কে আমাদের ভালোবাসবে? প্রভু, প্রকৃতি সহায় হবে না আর অন্তর থেকে।
ফেরাউনেরও অনেক সম্পদ ছিল, ক্ষমতার অহংকার ছিল। সে আজ কোথায়? পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে ফেরাউনের চিহ্ন, দেহ রেখে দেওয়া হয়েছে যাতে মানুষের শিক্ষা হয়। কিন্তু এত বুদ্ধিমান আমরা, নিজেদের বড়ই চতুর ভাবি। তলানিতে গিয়ে ঠেকবে সেই অহংকার। একদিন সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। তখন আর পালানোর পথ পাবে না মানবজাতি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, ডিজিটাল ডিভাইসের যুগে ভালোবাসার বহুরূপী রূপ চিনতে হবে। জীবনে চলতে চলতে এ রকমফের বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে সহিহ পথটিই বেছে নিতে হবে। ইন্টারনেট, মুঠোফোনই এখন অধিকাংশ অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ এনে দিয়েছে সহজেই। বয়স, রুচি আর দৈহিক সৌন্দর্য মনকে প্রলুব্ধ করছে। বারবার প্ররোচনার জন্য মুঠোফোনের কলই যথেষ্ট। মানুষ বারবার রিফিউজ করতে পারে না। মনের সেই জোর কোথায়? একদিকে চাহিদা, অন্যদিকে পুরো দুনিয়া নেটের দোরগোড়ায়। কিছুতেই যেন মানুষের আজ রেহাই নেই। মানুষ যেন নিজেকেই নিজে শেষ করার প্রযুক্তির উৎকর্ষের মহা আয়োজনে ব্যস্ত।
কল্পনার রাজ্যে বসবাসে ভালোবাসা অনুমোদন দেয় না। একে আমরাই কলুষিত করছি। ফুলের ঘ্রাণের বিকাশ খেয়াল করুন। কতটা ভালোবাসা দিয়ে ফুলের সৃষ্টি, ক্রমবিকাশ। যেই মৌমাছি ফুলের মধু খায়, তখনই ফুলগুলো কেমন যেন চুপসে যায়। এক সময় ঝরে পড়ে। ভালোবাসাও তেমন। একে বিশ্বাস, সততায় লালন–পালন করতে হয়। জীবনে দুঃখ–সুখ পাশাপাশি। একচেটিয়া কারও রাজত্ব নেই। ধৈর্যের দেয়াল, মানসিক দৃঢ়তা, অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে অবতীর্ণ করতে হবে। বাস্তবতা মনের আয়নায় দেখে নিতে হবে। স্রষ্টাকেই ভালোবাসাতে হবে সবচেয়ে বেশি। মনে রাখতে হবে, কবরে এই বিশুদ্ধ ভালোবাসা আমাদের নাজাতের জন্য সওয়াল করবে। ইমানদার বান্দার জন্য ভালোবাসা নিয়ামত, বেহেশতের এক টুকরা প্রশান্তি। তাই আসুন পবিত্র ভালোবাসা নিয়ে অযাচিত, অশোভন, লালসার খেলা বন্ধ করি। ক্ষণস্থায়ী জীবনে ভালোবাসার নিরাপত্তার চাদর মুড়িয়ে রাখুক সবাইকে, এই কামনা করি।
*লেখক: পারভীন আকতার, শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম