ব্যক্তিগত মেসে শিক্ষার্থীরা কতটুকু স্বস্তিতে থাকেন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

পড়াশোনা করছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের দ্বিতীয় পুরোনো ও সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় এটি। ৭৫৩ একর আয়তনের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ১৭টি হল থাকলেও এখন পর্যন্ত দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি প্রশাসন। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মেসে থাকতে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন মেসে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা? তাঁদের খবর কি কেউ রাখেন? আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিভিন্ন অজুহাতে নির্যাতন বা খবরদারি নতুন কোনো ঘটনা নয়। সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়া। কিন্তু যেসব শিক্ষার্থী মাসিক বড় একটা অঙ্কের বিনিময়ে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মেসে থাকেন, সেখানে তো আর কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের প্রভাব থাকার কথা না।

কিন্তু এরপরও এখানেও ভালো নেই শিক্ষার্থীরা। আসলে মূল সমস্যা রাজনীতি নয়, বরং সমস্যা আমাদের মরে যাওয়া মূল্যবোধ আর পচে যাওয়া মনুষ্যত্বের। মেসগুলোতে কোনো রাজনৈতিক শক্তির শিকড় দৃশ্যমান না থাকলেও প্রায় প্রতি মেসে থাকেন কিছু লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গির মূল্যবোধহীন একশ্রেণির শিক্ষার্থী, যাঁরা কেবল সিনিয়রত্বের দাবি করে সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর করে চালান শোষণের স্টিমরোলার। কখনো মিলের টাকা গড়মিল করে হাতিয়ে নেন, আবার কখনো বিভিন্ন কৌশলে চাঁদাবাজি করেন। এসব অন্যায়ের মাত্রা কোনো অংশেই হলগুলোতে বিদ্যমান ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অপকর্মের চেয়ে কম নয়। একজন সাধারণ মানুষ দ্বারা সংগঠিত নিষ্পেষণের ঘটনা মেনে নেওয়া যতটা না কঠিন, একজন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীর দ্বারা আরেকজন শিক্ষার্থীকে মানসিক নিপীড়ন মেনে নেওয়া এর চেয়ে বেশি কঠিন। আবার অনেক মেসে এমন দেখা যায়, যেখানে মেসমালিকের নিয়োগ করা গৃহকর্মী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণও করতেও দ্বিধা করেন না।

স্থানীয় বিপথগামীদের বাধাহীনভাবে মেসে আনাগোনা শিক্ষার্থীদের রুমে রক্ষিত মূল্যবান জিনিসপত্রকেও নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ফেলে। তা ছাড়া মাসিক ভাড়া বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি বিল ও নতুন নতুন নিয়ম তৈরি করে শিক্ষার্থীদের শোষণ তো মেসমালিকদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে যতটা না ঐক্যবদ্ধ, প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে নামে-বেনামে সমিতি গঠন করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি রাখতে মুনাফালোভী মেসমালিকেরা আরও বেশি সংকল্পবদ্ধ।

এভাবে পড়তে এসেও পদে পদে লাঞ্ছনা, জুলুম, নির্যাতন ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হওয়া বাংলাদেশে খুবই স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। তাই খবরের কাগজের উঠে আসা নির্যাতন–নিপীড়নের ঘটনাগুলো আমাদের তেমন বিস্মিত করে না। এমন প্রেক্ষাপটে ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে’—কালজয়ী গানের এ লাইনগুলো আমাদের দারুণভাবে আন্দোলিত করে।

অনেকেই আছেন, যাঁরা ক্যাম্পাসের হলে হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় শুধু ছাত্রসংগঠন বা রাজনীতিকে দায়ী করেন। কিন্তু ক্যাম্পাসবহির্ভূত বিভিন্ন ছাত্রাবাসে অরাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতেও যখন নিপীড়ন ঘটছে, সে ক্ষেত্রে আপনারা কাকে দায়ী করবেন? শুধু রাজনীতিকে দোষারোপ করে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়।

রাজনীতি কলুষিত হয়নি বরং নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষেরা রাজনৈতিক বলয়ে আশ্রয় নিয়ে রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। তাই রাজনীতি যেন কোনোভাবেই অপরাধীদের পুনর্বাসনের বলয়ে পরিণত না হয়, সেটা আমাদের রাজনীতিবিদদেরই নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধী যে-ই হোক, তাঁকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নৈতিক শিক্ষার ভিত্তিকে মজবুত করতে সামাজিক জাগরণ অপরিহার্য অনুষঙ্গ হওয়া উচিত বলে মনে করি। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সজাগ ভূমিকা পালন জরুরি।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়