বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কি কেবল মার খেয়েই যাবেন

নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়
ফাইল ছবি

আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে সভ্যতায় শিক্ষার যেমন কদর বেড়েছে, তেমনি সমাজ বিদ্যার্থীদের দিয়েছে মর্যাদার শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। অন্ধকারে নিমজ্জিত কুসংস্কার দূর করে জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষা ও গবেষণার বিকল্প নেই।

বিশ্বের প্রতিটি সভ্য দেশ তাদের শিক্ষা অর্জনে আগ্রহীদের তাই রেখেছে সুযোগ-সুবিধার ঊর্ধ্বে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, হালের উল্টো চিত্রই ফুটে ওঠে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোয়। এখানে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা তো পর্যাপ্ত নয়ই, বরং চুন থেকে পান খসলেই শিক্ষার্থীদের নানান প্রহারের শিকার হতে হয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে তাই গবেষণার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের নিজেদের অধিকার রক্ষার্থেই বেশি মনোযোগ দিতে হয়।

ছাত্রসংগঠনের গ্রুপ, উপগ্রুপ বা প্রতিপক্ষ দ্বন্দ্ব, কখনোবা প্রশাসনের সঙ্গে ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে বিরোধ অথবা অনৈতিকতা ও দুর্নীতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধাচরণ, এসব ক্ষেত্রেই সাধারণ শিক্ষার্থীর মার খাওয়া এক অতি স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।

ছাত্রসমাজের কথা উঠলে সেখানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নটা অনিবার্য হয়ে ওঠে। শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে সময়ে সময়ে শিক্ষাবিদেরা যেমন আধুনিকায়নের পথোদ্ধারের কথা বলেছেন, ঠিক তেমনি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও নিজেদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে রাখতে প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংকট বিগত কয়েক দশকে সৃষ্টি হয়েছে, তা উতরাতে অবশ্যই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দরকার। এর বাইরে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়াতে, আমাদের যতটুকু পোক্ত হওয়ার দরকার ছিল, তাতেও আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনগুলো ছাত্রদের দেখভালের জন্য গড়ে তোলা হলেও তারা মাঝেমধ্যেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে মারমুখী আচরণ করছে।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞানবিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার জন্য সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এতে রাষ্ট্র তার মেধাবী নাগরিকদের সহজেই সম্মুখ বহরে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু হাল আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রগুলো জ্ঞানবিজ্ঞান আর মুক্তবুদ্ধির চর্চায় সীমাবদ্ধ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোয় অদক্ষদের নিয়োগের ফলে বিদ্যাচর্চার এ মূল্যবান পীঠস্থানগুলো কলঙ্কিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেখানে গবেষণার পরিবর্তে ছাত্রদের হল ডাইনিংয়ের খাবারের মান নিয়ে ভাবতে হয়, মুক্তবুদ্ধির চর্চার পরিবর্তে ছাত্রসংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তিক চিন্তাচেতনায় ঘায়েল হতে হয়। অথচ অধিকাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত অথর্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের স্বার্থোদ্ধারে উদ্দেশ্য ভুলে ছাত্রদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী আচরণ করে। এর ওপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিবাদ, যা ইদানীং হরহামেশাই ঘটে চলছে। এতেও বলির পাঁঠা হচ্ছে ছাত্রসমাজ।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিবাদে ২০ জনের অধিক শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হন। গণমাধ্যমের খবর অনুয়ায়ী, সেখানে খুঁজে খুঁজে দিনভর নিরীহ ছাত্রদের ওপর হামলা করা হয়েছে। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা এর আগে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রদের সুরক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনামীয় প্রশাসকেরা কী করছেন? কেন ছাত্রদেরই বারবার মার খেতে হচ্ছে?

শিক্ষার্থীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ে মার খাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার খাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা জাতির সাফল্যগাথা আগামীর ভবিষ্যৎ আঁকতে গিয়েও মার খাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা এসব শিক্ষার্থী কেবল মার খেয়েই যাচ্ছেন। তাঁদের নিরাপত্তাহীনতায় রেখে একটি দেশ শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং দক্ষ জনবল তৈরিতে কখনোই সক্ষম হতে পারবে না। ছাত্রদের অবিচারে মার খাওয়ার সংস্কৃতি দ্রুতই বিলোপ না হলে দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাহীন কালো সমুদ্রে নিমজ্জিত হবে।

*লেখক: আকিজ মাহমুদ, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।