‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণে প্রাণ জোড়া লাগায়’

মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, বোকার মতো চাহনি আর দিক্‌ভ্রান্ত পথিকের মতো বেহিসাবি কদমযোগে ৫৫ একরে প্রবেশ করেছিলেন একঝাঁক তরুণ-তরুণী। সহস্র দিবস ও রজনী পেরিয়ে তাঁরাই আজ সবচেয়ে পরিণত, হিসেবি ও দায়িত্বশীল। রংচটা স্বপ্নের সঙ্গে তাঁরা বেড়ে ওঠেছেন, সন্ধি করেছেন প্রতিকূলতার সঙ্গে। অথচ মনের মণিকোঠায় এখনো সজীব ক্যাম্পাসের সেই আনাড়ি দিনগুলো। বলছি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ২০১৬-১৭ ও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর কথা, যাঁরা অতিসম্প্রতি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সাঙ্গ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন।

তারুণ্যের অফুরান প্রাণশক্তিতে ভর করে একসময় অজস্র আকাঙ্ক্ষা, অভিলাষ নিয়ে তাঁদের হাতেখড়ি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বপ্ন পানে ছুটে চলা এসব তরুণের অমসৃণ পথচলায় রয়েছে মিশ্র অনুভূতি। বাবা-মায়ের কঠিন নজরদারি থেকে বেরিয়ে হঠাৎ পাওয়া অবাধ স্বাধীনতা, নতুন পরিবেশে অভিযোজনের চাপ কিংবা নতুন বন্ধু বানানোর ব্যগ্রতা! কোনটা বেশি মনে পড়ে? নাকি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সদলবলে ঘুরতে যাওয়া, প্রক্সি দেওয়া, ব্যাকবেঞ্চার তকমা মাখানো, রিটেককে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষার আগের রাতে নির্ঘুম কসরত, রাতের বারবিকিউ পার্টি, তাসের প্যাকেটে রাত পার করে দেওয়া, ব্যাচ ট্যুর, অবেলায় বেসুরো গান, কিংবা হলরুমের সব অব্যক্ত গল্প!

কোনটিতে বেশি স্মৃতিকাতরতায় ভুগছেন সদ্য বিদায়ী এসব শিক্ষার্থীরা?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মাকছুমুল আরেফিন বলেন, ছয় বছরের ক্যাম্পাস–জীবনে বন্ধু, ব্যাচমেট, অগ্রজ, অনুজ, শিক্ষক—সবাইকে মিস করব। মেস ও হল–জীবনের সুখস্মৃতি অসংখ্য। চাওয়া–পাওয়ার অসম বণ্টন ছাড়িয়ে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে যাচ্ছি। ক্লাসরুম, বালুর মাঠ, হাফিজ মামার টং ও স্বেচ্ছাসেবী কাজগুলোকে ভীষণ মনে পড়বে। প্রিয় ক্যাম্পাস! বুঝতে শেখার বয়সটাতে তোমার প্রেমে-ই পড়েছি।

ক্লাসে দেরিতে আসায় স্যারের ঝাড়ি খাওয়া, শিক্ষকদের পরামর্শে জীবনচর্চায় ইতিবাচক পরিবর্তনের স্মৃতিগুলো আজীবন রঙিন থাকবে। প্রয়াত মসিউর রহমান স্যারের বাচনভঙ্গি, উদার চিন্তা, বোধের বিকাশে দর্শনগুলো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান পাঠ বলে জানান ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী অন্তর রহমান।

যমদূতের মতো ভয় পাওয়া বড় ভাইটার সঙ্গে এক টেবিলে চা খাওয়ার স্মৃতিগুলো বেশি মনে পড়বে উল্লেখ করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অভিক সাহা বলেন, কালক্রমে আমাদের গল্পের পাতায় কেবল বাড়েনি, বেড়েছে আমাদের জীবনে পারস্পরিক নির্ভরতা, আস্হা ও শুভকামনার আকুতি।
নবীন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে, যেটা প্রবীণ উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সচারচর হয় না। ক্লাসরুম অপ্রতুলতা, শিক্ষকের সংকটসহ নানা প্রতিকূলতায় কেটেছে একাডেমিক জীবন। এখন অবশ্য সুবাতাস লাগছে এসবে। সহপাঠীদের মধ্যে বহুমূখী প্রতিভাধর ও যোগ্যরা শিক্ষক ও কর্মকর্তা হিসেবে প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে ফিরলে সেটা বেশ ফলদায়ক হবে—এমনটাই মনে করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ পিয়াস।

বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে নিয়মের খাতিরে। অথচ মনে হচ্ছে এই তো সেদিনই এলাম। মাঝে কত প্রাণ মিশে গেছে অন্য প্রাণে! আন্দোলন–সংগ্রামে লড়াই করেছি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। অশ্রুসিক্ত নয়নে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী রেহনুমা তাবাচ্ছুম আরও যোগ করেন, পরস্পরের সুখ-দুঃখের সমান হিস্যার অন্তিম ক্ষণ সত্যিই বেদনার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক বদরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে আমার ও তাঁদের ছাত্রজীবন প্রায় একই সময়ে বেড়ে ওঠেছে। পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক দুপক্ষই সমৃদ্ধ হয়।’ নিজের প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সততা, ন্যায় ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক হিসেবে দেশের কল্যাণে নিজেদের সেরাটা নিংড়ে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ ও বহির্বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করবে।’

মাহমুদুল হাছান, শিক্ষার্থী, বশেমুরবিপ্রবি।