বাসের ভাড়ানৈরাজ্য কি চলতেই থাকবে
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠায় ‘১৩ টাকার ভাড়া ২০ টাকা আদায়, নৈরাজ্য চলছেই’ শিরোনামে লেখাটি পড়লাম। জনস্বার্থে খবরটি প্রকাশ করায় প্রথম আলোকে সাধুবাদ জানাই। জনগণের কল্যাণে প্রথম আলো সব সময় তার চিন্তাকে উদ্ভাসিত করবে, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা। দেশের পরিবহনব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য কারও অজানা নয়। সড়কে ভাড়ানৈরাজ্য কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।
ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর ফলে সরকার গত বছরের ৭ নভেম্বরে বাসভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ায়। ১০ নভেম্বর ২০২১ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয় তিন দিনের মধ্যে রাজধানী ঢাকার সব সিটিং ও গেটলক সার্ভিস বন্ধ করা হবে। কিন্তু অদ্যাবধি পর্যন্ত তা বন্ধ হয়নি। বরং সিটিং সার্ভিসের নামে ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। ন্যায্য ভাড়া দিলেও বাসের হেল্পার–কন্ডাক্টররা দুর্ব্যবহার করছেন। রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে চেক পোস্টের দোহাই দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলেও নালিশ করার জায়গাটুকু আমাদের নেই। এর আশু অবসান কাম্য।
বিআরটিএ নির্ধারিত চার্টের নিয়ম অনুসারে ভাড়া আদায় করার কথা থাকলেও বাসচালকের সহকারী ওয়েবিল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় করতে গিয়ে বাস থেকে যাত্রী ফেলে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করেছেন না। তাঁদের দুর্ব্যবহার ও অমানবিক আচরণে সাধারণ যাত্রী তটস্থ থাকেন। প্রতি কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও ওয়েবিলের দোহাই দিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিআরটিএর দৃশ্যমান ভূমিকা চোখে পড়েনি। অথচ বিআরটিএ ইচ্ছা করলে ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিল করতে পারে। শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করলে একপর্যায়ে দাবি মেনে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবু সড়কে ভাড়ানৈরাজ্য থামেনি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে হাফ ভাড়া নিয়ে তর্কবির্তকে হাতাহাতি লেগেই থাকে। নতুন ভাড়া নির্ধারণ করার পর কোনো পরিবহন বেশি ভাড়া নিলে জাতীয় জরুরি সেবা সার্ভিস নম্বর ৯৯৯–এ অভিযোগ করলে পুলিশ গাড়ি আটক করার পাশাপাশি জরিমানা করত। এখন আর তেমটি দেখা যায় না। বিআরটিএ জনবল দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য কিছুটা হলেও কমত। রাজধানী ঢাকায় কোনো কোনো রুটে ওয়েবিল পদ্ধতির নামে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে, তা বিআরটিএর আড়ালে হচ্ছে না। প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় চেকিং হচ্ছে। বিআরটিএ উদ্যোগী হলে ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিল করতে পারে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে পারে। যাত্রীদের সুবিধার্থে জাতীয় জরুরি সেবা সার্ভিসের মতো বিআরটিএ জরুরি সেবা সার্ভিস চালু করতে পারে। আমরা মালিকপক্ষের চেকিংয়ের বিরোধী নই। সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের পক্ষে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরোধী। প্রতিটি বাসে ভাড়ার চার্ট রাখা বাধ্যতামূলক হলেও বেশির ভাগ বাসই ভাড়ার চার্ট রাখছে না। যাত্রীরা চার্ট অনুযায়ী ন্যায্য ভাড়া দিতে চাইলেও কন্ডাক্টর–হেল্পার বিরোধে জড়াচ্ছেন।
গত ২০ জানুয়ারি এক যাত্রী ডেমরা থেকে বাসে করে গুলিস্তানে যাচ্ছিলেন। ভাড়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে রাজধানীর ওয়ারীতে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় তাঁকে। এতে ওই যাত্রী মারা যান। বাসচালকের সহকারী ২০ টাকার ভাড়া চাইলে ওই যাত্রী ১৫ টাকা ভাড়া দেন। মাত্র পাঁচ টাকার জন্য একজন যাত্রীকে এভাবে বাস থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় বিআরটিএ কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আমরা জানি না। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। ওয়েবিল চেকিংয়ের ফাঁদে প্রত্যেক যাত্রীকে প্রতিটি চেকিংয়ে অতিরিক্ত পাঁচ টাকা দিতে হচ্ছে। যেমন রাজধানীর খামারবাড়িতে লাব্বায়েক ও লাভলীর চেকিং পোস্ট আছে। একজন যাত্রী মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ (খামারবাড়ি) থেকে আসাদ গেট যাবেন। ওয়েবিল চেকিংয়ের কারণে তাঁকে ১৫ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা দিলেও তাঁরা নিচ্ছেন না। ফার্মগেট থেকে কোনো যাত্রী উঠতে চাইলে আগেই বলা হচ্ছে, আসাদগেট পর্যন্ত ১৫ টাকা ভাড়া দিতে হবে। মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে কারওয়ান বাজার হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত চার্ট অনুযায়ী ভাড়া ২২ টাকার জায়গায় সব বাসে ৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কল্যাণপুর থেকে মগবাজারের ভাড়া ১৪ টাকা। অথচ লাভলী ও লাব্বাইক পরিবহন ২৫ টাকা নিচ্ছে। এ রকম ঘটনার ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে।
দেশের পরিবহনব্যবস্থার নৈরাজ্য নতুন, তা কিন্তু নয়! বছরের পর বছর ধরে এই নৈরাজ্য চলছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে বাসের চালক ও বাসচালকের সহকারীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সরকার নির্ধারিত ভাড়া না নিয়ে ওয়েবিলে ভাড়া নিচ্ছেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তাঁদের সাফ উত্তর হচ্ছে, ‘মালিক আমাদের যেভাবে ভাড়া নিতে বলছেন, আমরা সেভাবেই নিচ্ছি। চার্টে কী আছে, কিলোতে কত টাকা, সেসব জানার দরকার নেই।’ গণপরিবহনের অনিয়ম রোধে বা নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএর ভূমিকা সন্তোষজনক নয়! ফলে ভাড়নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। ভাড়ানৈরাজ্য কমানোর জন্য রাজধানী ঢাকায় যেসব পরিবহনের চেকিং আছে, ওই সব স্থানে নির্দিষ্ট ভাড়ার চার্ট ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে জরিমানা ও শাস্তির বিধান বিলবোর্ডে লেখে টাঙিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে হাইকোর্টেরও একটি আদেশ আছে। আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়িত হলে ভাড়ানৈরাজ্যের হাত থেকে যাত্রীরা মুক্তি পেতে পারেন।