বাজেটে শিক্ষা খাতের সুখবর কই
মহান জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য আয়-ব্যয়ের বার্ষিক পরিকল্পনা তথা বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং দিন শেষে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগ-বিয়োগে ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট একটি দেশকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে বাজেট হয় ভারসাম্যপূর্ণ, জনকল্যাণমূলক, সর্বোপরি গ্রহণযোগ্য। জনকল্যাণমুখী বাজেটই সর্বোত্তম বাজেটের বৈশিষ্ট্য৷ তাই সরকারেরও উচিত আয়-ব্যয়ের ‘গাছ-পাথর’ মিটিয়ে বাজেট যেন জনকল্যাণমুখী হয়, তার দিকে পূর্ণ মনোনিবেশ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে করোনা মহামারি–পরবর্তী শিক্ষা খাতের সংকট নিরসনে আলাদা কোনো উদ্যোগ তো দূরের কথা, বাজেটে আশানুরূপ বরাদ্দও মেলেনি। করোনায় বিপর্যস্ত শিক্ষা খাতকে পুনর্বাসনে যেখানে অতিরিক্ত বরাদ্দ দরকার ছিল, সেখানে শিক্ষাবিদদের দাবির তোয়াক্কা না করে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ হতাশাজনকও। দেশের শিক্ষাবিদ ও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের নেতারা দাবি করে আসছিলেন, বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হোক। কিন্তু এই দীর্ঘদিনের এ প্রত্যাশায় এবারের বাজেটেও আশা গুড়েবালিতেই ডুবে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এবারের বাজেটে বিপর্যস্ত শিক্ষা খাতে বড় ধরনের সুখবর মেলেনি।
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিক্ষায় ঝরে যেতে পারে বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থী। বেড়ে যেতে পারে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ। এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১০ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনাদি বন্ধ হয়ে আছে। দেশে করোনাকালে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বেড়ে চলছে। এসব থেকে উত্তরণে স্বাভাবিকভাবেই যেখানে বিশেষ উদ্যোগ জরুরি ছিল, সেখানে উল্টো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল শিক্ষায় ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে! এই সিদ্ধান্ত শিক্ষাবান্ধব তো নয়ই, বরং ব্যবসাবান্ধব বলাও বাহুল্য নয়। গত কয়েকটি বাজেটেই আমাদের শিক্ষাবিদেরা বাজেটে জিডিপির ৬ শতাংশ দাবি করে আসছে। আজও সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও নেপালে ২০১৮ সালের বাজেটে যথাক্রমে জিডিপির ৬ দশমিক ৬ ও ৫ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। আর ২০১৭ সালে আফগানিস্তানের মতো দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ৷ সেখানে আমাদের দেশে ২০২০ সালে এসে ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বরাদ্দ ছিল৷ এবারও ২০২১-২২ বছরে শিক্ষা খাতে মোটের ওপর সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়লেও শিক্ষাবিদদের চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার মেলাবন্ধন বহুদূর। জিডিপির হিসাবে ৬ শতাংশ চাওয়া এবারও সুদূরপরাহত। এসব চিত্রে শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিবর্তে অবহেলাই দৃশ্যমান হয়।
শিক্ষাকে অবজ্ঞা করে যে জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণের স্বপ্ন দেখবে, নিঃসন্দেহে এগুলো বৃথা স্বপ্নেই রূপ নেবে। অথচ আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি। শিক্ষা ও শিক্ষকদের অগ্রাহ্য করে তা কীভাবে পূরণ করা সম্ভব, তা সত্যিই বোধগম্য নয়। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, জীবন বাঁচানোর কার্যক্রম যেখানে পর্যাপ্ত নয়, সেখানে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা কতটা যৌক্তিক? আসল ব্যাপার হলো শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে জীবন বাঁচানোর জন্যই। শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা আগামীর করোনামুক্ত পৃথিবীতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাব না, বরং শিক্ষার দৈন্যতায় আগামীতে কোনো মহামারি কিংবা বিপর্যয়ে আমরা আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ব। যার জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের স্বাস্থ্য খাতের সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খল দৃশ্য। তাই শিক্ষাকে দূরে ঠেলে আগামীর দেশ গড়ার স্বপ্ন হবে বোকার স্বর্গে হাতড়ে বেড়ানোর মতোই। সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সমন্বিত চিন্তা নিয়ে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, দেশে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অনেক।
আমরা জানি, অনেক সময় এ দেশে বহু অনুৎপাদনশীল খাতে অযথাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সময় ব্যয় করা হয়। অথচ সেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু শিক্ষার মতো জরুরি এ খাতে বর্তমান বরাদ্দ নিতান্তই কম। তাই শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও প্রণোদনা এখন সময়েরই দাবি। কারণ, শিক্ষক বাঁচলেই শিক্ষা বাঁচবে। শিক্ষার আলোতেই আসবে টেকসই প্রবৃদ্ধি। সুতরাং শিক্ষক ও শিক্ষা খাত বাঁচাতে আমাদের সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা করতে হবে। সেটা এখনই করতে হবে।